ঘূর্ণিঝড় রেমাল: উপকূলীয় নদীতে পানি বেড়েছে ৫-৭ ফুট
বিডিনিউজ:
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। কিছু নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ থেকে সাত ফুট বেশি পানি বাড়ার খবর পাওয়া গেছে।
রোববারসন্ধ্যার পর থেকেই উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করতে শুরু করেছে রেমাল। এর আগেই বিভিন্ন নদীতে পানি বাড়তে শুরু করে।রাতেজোয়ারের সময় তা আরও বাড়ার শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
এ ছাড়া দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টিতে উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীগুলো উত্তাল হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর
বাগেরহাট: ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে রোববার উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের প্রধান প্রধান নদ-নদী বিপৎসীমার উপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অতি জোয়ারে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে; এতে বনের প্রাণির প্রাণহানির আশঙ্কা করছে বনবিভাগ।
রোববার দুপুরে জেলা সদর, মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও রামপাল উপজেলার নদীর তীরবর্তী এলাকার দুই শতাধিক বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল-বিরুনী বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাগেরহাটের প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি দুপুরে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি পানি বেড়েছে জেলার মোংলা উপজেলার পশুর নদে।
“মোংলা বন্দরের এই নদে দুপুরে বিপৎসীমার ৫ ফুট উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। আর বলেশ্বর ও ভৈরব নদে বিপৎসীমার দুই থেকে তিন ফুট উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।”
সুন্দরবনের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বিকালে বলেন, ঝড়ের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে পানির অস্বাভাবিক চাপ রয়েছে। দুপুরের জোয়ারের পানি সুন্দরবনের সব নদ-নদীতে প্রবাহিত হয়। সেই পানির উচ্চতা ছিল পাঁচ থেকে আট ফুট পর্যন্ত।
রাতের জোয়ারের পানির চাপ আরও বাড়লে কী হবে তা নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় এই বন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “সাধারণত মাছের ঘেরগুলো একটু উঁচু জায়গায় করা হয়। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি, শতাধিক পুকুর এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে।”
পটুয়াখালী: সাগরের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার নদ-নদীর পানি ৭-৮ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলার রাঙ্গাবালী, কলাপাড়া ও মির্জাগঞ্জে বেশ কিছু স্থানে বেড়ীবাধ উপচে গ্রামের মধ্যে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে।
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মিরাজ গাজী জানান, গলাচিপার পানপট্টি, মুসুরীকাঠি স্লুইজ, সদর উপজেলার কালিচন্না, দুমকির হাজিরহাট, দশমিনার আউলিয়াপুর এলাকায় বেড়িবাধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে সকালে ৪-৫ফুট পানি বৃদ্ধি পেলেও বর্তমানে পানি কমে গেছে।
তবে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায় জলোচ্ছ্বাসের কারণে নদ-নদীর পানি ৭-৮ ফুট পর্যন্ত অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়িবাঁধ উপচে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর পর গ্রাম।
উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দক্ষিণ চরমোন্তাজ, আন্ডারচর ও চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বেড়ীবাঁধ উপচে পানি ঢুকে অন্তত ৩০টি গ্রাম, মির্জাগঞ্জের মেহেন্দিয়াবাদ ও সুন্দ্রা পয়েন্টে বেড়ীবাঁধ উপচে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া কলাপাড়ায় বেড়ীবাঁধের বাইরে নিশানবাড়ীয়া, কাউয়ার চর এলাকা পানিতে থৈ থৈ করছে।
কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বেড়িবাঁধগুলো স্বাভাবিক জোয়ারের উপর হিসাব করে নির্মাণ করা। কিন্তু সাগরের অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে সকালের দিকে ৭-৮ ফিট পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রাঙ্গাবালীর বেশ কিছু এলাকার বেড়িবাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়েছে।
“এতে বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি নেমে গেলে বোঝা যাবে বেড়িবাঁধ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
সাতক্ষীরা: ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ফুঁসে উঠেছে খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদসহ সাতক্ষীরার নদীগুলো। জোয়ারের আগেই নদীগুলোয় পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে ছয় ফুটের বেশি।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী সালাউদ্দিন জানান, জেলার উপকূলীয় গাবুরা, পদ্মপুকুর, প্রতাপনগর এলাকায় খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদের পানি এর মধ্যেই স্বাভাবিকের চেয়ে ছয় ফুটের বেশি বেড়েছে।
ভোলা: ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী। সকাল থেকে থেমে থেমে বইছে ঝড়ো বাতাস, সেই সঙ্গে রয়েছে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টি।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান-উজ-জামান জানান, ঝড়ের প্রভাবে সকালে জেলার মেঘনা নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পরে তা বাড়তে বাড়তে বিকাল ৫টার দিকে ৫৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
তবে সন্ধ্যার পর নদীর পানির স্তর কমতে থাকে বলে জানান এই প্রকৌশলী।
এদিকে জেলায় ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ ৪০ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হচ্ছে।
বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে ভোলার সদরের ধনিয়া, নাছির মাঝি, রাজাপুর, শিবপুর, চটকিমারার চর, চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, কুকরী-মুকরি ও চর পাতিলা, দৌলুতখানের সৈয়দপরসহ মনপুরার বেশ কিছু নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
এরই মধ্যে ভোলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৫ হাজার পরিবার।
জেলা প্রশাসক মো. আরিফুজ্জামান জানান, “ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবিলায় আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। বেশ কিছু নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। ওই সব উপকূলের মানুষকে নিরাপদে আনার কাজ শুরু হয়েছে।
খুলনা : ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার সঙ্গে খুলনা উপকূলের নদ-নদীতে পানির উচ্চতা বাড়ছে। স্বাভাবিক সময়ে ভাটায় পানি নেমে গেলেও রোববার বিকালে তা হয়নি। বরং নদীতে স্বাভাবিকের চাইতে পানির উচ্চতা ৩-৪ ফুট বেশি রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে খুলনা উপকূলে দমকা হাওয়া ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে সকাল থেকে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি থেমে, কিছু সময় পর আবার হচ্ছে। এতে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ৩-৪ ফুট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালি এলাকার ঝুলন্ত পাড়ায় ডুবে যাওয়া বাড়ির দরজায় বসে আছেন অসহায় এক নারী।
খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালি এলাকার ঝুলন্ত পাড়ায় ডুবে যাওয়া বাড়ির দরজায় বসে আছেন অসহায় এক নারী।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ আশরাফুল আলম বলেন, জোয়ারে নদীতে পানি এবং পানির চাপ বেড়েছে। খুলনার নদ-নদীতে বিপৎসীমার ৩ ফুট ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
তিনি জানান, খুলনার সবচেয়ে বড় নদী শিবসার স্বাভাবিক পানি প্রবাহ থাকে ১ দশমিক ৭৬ মিটার। এর বিপদসীমা ১ দশমিক ৩৭ মিটার। সেখানে প্রবাহিত হচ্ছে ২ দশমিক ৯৪ মিটার ওপর দিয়ে।
পশুর নদীতে পানি প্রবাহের বিপদসীমা ১ দুই দশমিক ৪৫ মিটার। তা বেড়ে হয়েছে ২ দশমিক ১৭ মিটার। কপোতাক্ষ নদীর বিপদসীমা ১ দশমিক ৯৫ মিটার। বিপদ সীমা ছাড়িয়ে ২ দশমিক ৪৭ মিটারে পৌঁছেছে।
এছাড়া, দাকোপের সুতোরখালি এলাকায় ভদ্রা নদীর বিপদসীমা ১ দশমিক ৭০ মিটার, তাও অতিক্রম করে করেছে পানি।
বরিশাল: ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বরিশালের নদীগুলোর পানি বাড়লেও তা বিপৎসীমা ছাড়িয়ে যায়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ ওয়েব অলীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জেলার কোনো নদীর পানি বিপৎসীমা পার হয়নি। সব নদীর পানি বিপৎসীমার থেকে ২ থেকে ৩ ফুট নিচে রয়েছে।
তবে নদীগুলোয় পানি বেড়েছে। এতে নিম্নাঞ্চলে কিছু এলাকায় পানি উঠেছে। তা আবার নেমে যাবে বলে আশা করছেন এই প্রকৌশলী।
আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
বর্তমান উত্তরমুখী গতিপথ অব্যাহত থাকলে প্রবাল ঘূর্ণিঝড় রেমাল রোববার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাতের মধ্যে বাংলাদেশের খেপুপাড়া ও ভারতের সাগর দ্বীপের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
আবহাওয়া কার্যালয় আরও বলছে, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপের পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সাবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮-১২ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।