জলের গণতন্ত্রেই নদী ও পানির ভবিষ্যত
নদী ও পানির অধিকার রায় বাংলাদেশে এখনও জন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়নি। আইনের সীমাবদ্ধতা, সাধারণ মানুষের চিন্তা ও মতামতকে কম গুরুত্ব দেয়ার করণে এই পরিস্থিতি। ফলে দেশের ভেতরে পানির জন্য হাহাকার, দখল ও দূষণ। আঞ্চলিকভাবে পানি অধিকার বঞ্চিত বাংলাদেশ।
বুধবার পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় দু’দিনব্যাপি ‘জল ও জনতন্ত্র’ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন পানি ও নদী বিশেষজ্ঞরা। যেখানে বলা হয় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পানির রাজনীতিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ। এই পরিস্থিতির উন্নতিতে নদীকে থাকতে দিতে হবে নদীর মতো। পানিকে তার প্রাকৃতিক সত্তায় চলতে দিতে হবে। আর এটি করতে হলে দরকার জনঅংশগ্রহণমূলক পানি ও নদী ব্যবস্থাপনা। তাই জলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাতেই নদী ও পানির ভবিষ্যৎ বলে মনে করছে আয়োজক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘জল ও জনতন্ত্র’-এর ধারণাপত্র এবং সাম্প্রতিক একটি গবেষণার চিত্র তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার শমসের আলী। সেখানে বলা হয়, পানির কৃত্রিম সংকটের ফলে নদীপাড়ের মানুষ তাদের জীবিকা হারাচ্ছে, জীব-বৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখিন; বৃদ্ধি পাচ্ছে লবনাক্ততা; জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি, মৎসসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে খারাপ উদাহরণ তৈরি হচ্ছে। তার থেকে ভয়ংকর পরিস্থিতি হলো, নদী মরে যাওয়া, মেরে ফেলা এবং পানির অধিকার ক্ষুণ্ন করা। সাধারণ মানুষের চিন্তা মত ও উদ্যোগ যুক্ত না হওয়ায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, নদীর অধিকার না থাকা মানে নদীকে মেরে ফেলা। ভোট দেয়ার মতো পানি পাবার অধিকার মানুষের রয়েছে। তাই পানি বিষয়ে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নদীর পরিস্থিতির উন্নতিতে আমাদের দেশের রাজনীতি একটি বড় বিষয়। সেখানেই পানির অধিকার রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক একশনএই বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, বাংলাদেশে যত উন্নয়ন বা উন্নয়ন চিন্তা হয়েছে, তার পুরাটাই জমিকেন্দ্রিক। উন্নয়ন ভাবনায় পানি কিংবা নদীর গুর“ত্ব দেয়া হয়নি। ফলে নদী মরে যাচ্ছে, ভাঙছে, হারিয়ে যাচ্ছে। সমস্যায় পড়ছেন নদীপাড়ের মানুষ। প্রভাব পড়ছে গ্রাম থেকে শহরে। তবে দেশের ভেতরে বা আহঞ্চলিক কারণে নদীর বিষয়ে সধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করা হয় না। যে আলোচনাটি হয় তা বিক্ষিপ্ত ও ধারণাপ্রসূত।
একশনএইড ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং বাংলাদেশ-এর ‘মানুষ ও পানির অধিকার’ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। সেই গবেষণায়ও বলা হয়েছে বাংলাদেশের নদী পাড়ের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, এদেশের পানি ও নদী নিয়ে সমস্যার মূল কারণ ভারত। এই ধারণার কারণ, দু’পাড়ের সাধরণ মানুষের কাছে নদী ও পানি বিষয়ে পরিস্কার ধারণা নেই।
এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ার পানির সুশাসন বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্-এর শিক্ষক মেহেরুন্নেসা বলেন, আমরা সব সময় সরকার ও ভারতের দোষ দেই। কিন্তু নদী ও পানি পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সঠিকভাবে জানি না। নদীদূষণের জন্য আমরা কতটুকু দায়ী তা বুঝতে চাই না। তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
নদীর জনতন্ত্র বিষয়ে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, সমস্যার সমাধানের জন্য যদি সঠিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে উপস্থাপন করতে না পারি তাহলে নীতি-নির্ধারকদের কাছে গুরুত্ব পাওয়া যাবে না। সমস্যার সমধান আসা উচিৎ প্রান্তিক মানুষের কাছ থেকেই। কারণ তারাই নদী ও পানি নিয়ে সবচেয়ে বেশি জানে। যেহেতু আমাদের অনেক নীতির মধ্যে সমস্যা রয়েছে তাই স্থানীয়দের অভিজ্ঞতাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে স্থানান্তর করে উদ্যোগ নিতে হবে। পানির পরিমাণ সীমিত কিন্তু চাহিদা ক্রমবর্ধমান, পানির সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। নদী ভাঙন নদীর গতিপথ অনুযায়ী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অনেক জ্ঞান আছে। এই জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে’।
তিনি আরো বলেন, পানি ব্যবস্থাপনায় নারীদের ভ‚মিকা বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। কারণ, নারীদের কাছে পানি নিয়ে অনেক চিন্তাশীল ও বাস্তব জ্ঞান আছে। স্থানীয় পর্যায়ের জ্ঞান সঠিক পর্যায়ে কাজে লাগাতে পারলে আমরা ভালো ফল পাবো’।
পানির অধিকার নিয়ে কথা বলেন নেপালের মহিলা অধিকার মঞ্চ-এর উপদেষ্টা সাবিত্রি পোখারেল বলেন, অধিকারের বিষয়টি খুবই গভীর একটি বিষয়। এর সাথে প্রতিটি জীবন জড়িত। পানি ছাড়া বাঁচা যায় না এবং মরাও যায়না। সবাই মিলে কাজ না করলে পানি অধিকারের বিষয়ে আমরা সফল হবো না। তাই তৃণমূল পর্যায় থেকে সংগঠিত হয়ে, দক্ষিণ এশিয়ার আন্তদেশীয় সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করতে হবে’।
দু’দিনব্যাপি এই আয়োজনে প্রথম দিনে বিশেষণমূলক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন চারজন বিশেষজ্ঞ। যেখানে নদী ও পানির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে। নদী ও পানির অধিকার রক্ষায় উপোরক্ত বিষয়ে একটি সঠিক দিক-নির্দেশনা তৈরি করাই এই সম্মেলনের প্রয়াস। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে পানির অধিকার রক্ষায় একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে।