জৈব প্রযুক্তি: বদলে যেতে পারে বিশ্বরাজনীতি, শাসনকাঠামোসহ সবকিছু
ব্রিটেনের জন ইনস সেন্টার—যেখানে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ উৎপাদনের কাজ করা হয়। গবেষণা কেন্দ্রের ইনকিউবেটরে এমনই কিছু জিন সম্পাদিত উদ্ভিদের বীজ হাতে গবেষক। ছবি: রয়টার্স
ব্রিটেনের জন ইনস সেন্টার—যেখানে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ উৎপাদনের কাজ করা হয়। গবেষণা কেন্দ্রের ইনকিউবেটরে এমনই কিছু জিন সম্পাদিত উদ্ভিদের বীজ হাতে গবেষক। ছবি: রয়টার্স
জৈব প্রযুক্তিও জিন প্রকৌশলের হাত ধরে ঠিক কী কী পরিবর্তন আগামী পৃথিবী দেখবে, তা এই সময়ে বসে কল্পনা করাটাও এমনকি কঠিন। কিন্তু মানবেতিহাসের পেছনে তাকালে কিছু অনুমান করা সম্ভব।
স্বপ্রাণ পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ধারাটির দিকে তাকালে দেখা যাবে নানা ধাপ। যে পশুপালন ও কৃষির উদ্ভবের মধ্য দিয়ে মানুষ তার সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিল, তা আজকে জীবাশ্ম জ্বালানির অপব্যবহার ও বাস্তুতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে এক সীমান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে শেষ দুটি আজ বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধটি এমনভাবে রচিত হয়েছে যে তা মানুষের ইতিহাসে যেমন সম্পদ বিবেচনায় সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে, তেমনি তৈরি করেছে ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যা এখন মানুষকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মূলত প্রকৃতি থেকে মানুষের বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্য দিয়েই এই ভয়াবহ বর্তমানের নির্মাণ। সে ভিন্ন আলোচনার বিষয়। না বললেও চলে যে আজকের জৈবপ্রযুক্তিও ঠিক আগের মতোই সংকট ও সম্ভাবনাকে হাত ধরাধরি করে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।
যে জীবাশ্ম জ্বালানির বদৌলতে আজ মানুষ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে, তা-ই পৃথিবীকে আবার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের কারণে জলবায়ুতে যে পরিবর্তন এসেছে ও আসছে, তাতে বহু প্রজাতি বিলীন হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এই বিলীন হওয়ার প্রক্রিয়া এখনো চলমান। যখন বিপদ স্বয়ং এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে, তখন মানুষ জ্বালানি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। আর এই ভাবনায় একটি ভালো বিকল্প হতে পারে জৈবপ্রযুক্তি।
এরই মধ্যে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন কিছু দ্রব্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছে, যা এর আগে শুধু পেট্রোকেমিক্যাল থেকেই উৎপাদিত হতো। অচিরেই হয়তো এটি নতুন জ্বালানি উৎপাদনেও বড় অবদান রাখবে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, এই কিছুদিন আগেই বার্গার কিং তাদের রেস্তোরাঁগুলোয় নিয়ে এসেছে নতুন বিফ বার্গার। খেতে গরুর মাংসের মতো হলেও এতে যা দেওয়া হয়েছে, তা উদ্ভিজ্জ প্রোটিন থেকে জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা। এই উদ্ভাবন নিঃসন্দেহে পরিবেশবাদীদের উদ্দীপ্ত করবে। এমনকি প্রচলিত সার ও কীটনাশকের বিকল্পও চলে এল বলে। উদ্ভিদ ও মাটিতে থাকা অণুজীবেরাই যৌথভাবে নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় সার ও কীটনাশক উৎপাদন করবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নতুন প্রতিষ্ঠান বোল্ট থ্রেডসের কথা, যারা মাকড়সার তন্তু থেকে সংগৃহীত প্রোটিন দিয়ে তৈরি করছে নতুন ফেব্রিক। একই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে ছত্রাক থেকে চামড়া উৎপাদনের উপায় নিয়ে। একই সঙ্গে প্রচলিত পণ্যের সস্তা ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প নিয়ে আসছে তারা। এমন বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা স্বাদ, গন্ধ—সব প্রকরণে কৃত্রিম মাংস উৎপাদনে কাজ করছে। সান ফ্রান্সিসকোর রেস্তোরাঁগুলো এখন মোটামুটি এই কৃত্রিম মাংসের ওপরই বেশি আস্থা রাখছে, যা তৈরি হচ্ছে জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে অণুজীব থেকে। এতে পরিবেশবাদীরা নিঃসন্দেহে আনন্দিত হবে। কারণ, এতে করে প্রাণী হত্যা কমে আসবে।
এ বিষয়ে পুঁজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আন্দ্রিসেন হোরোউইটজের বিজয় পান্ডে ইকোনমিস্টকে বলেন, কৃত্রিম মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এটি খুবই ভালো। কারণ, তাহলে সস্তায় প্রোটিনের সরবরাহ করা যাবে। একই সঙ্গে পরিবেশেরও ক্ষতি হবে না। অন্তত একটি কোম্পানি কৃত্রিমভাবে ফোয়ি গ্রাস (হাঁসের কলিজা দিয়ে বিশেষ উপায়ে তৈরি একধরনের ফরাসি খাবার) তৈরিতে কাজ করছে। এটি সম্ভব হলে প্রাণী অধিকারকর্মীরা নিশ্চিতভাবেই খুশি হবেন।
জৈব প্রযুক্তি শুধু অভিনব উদ্ভাবন নিয়েই হাজির হচ্ছে না, এটি এক নতুন ধরনের অর্থনীতির আভাসও দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড মেশিন (আইজেম) সম্মেলনে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকটি দল নতুন জৈব প্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান খুলেছে। এর মধ্যে গিঙ্কগো বায়োওয়ার্কস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর প্রতিষ্ঠাতারা আইজেমে অংশ নিয়েছিল ২০০৪ ও ২০০৬ সালে। পরে তারা গিঙ্কগো প্রতিষ্ঠা করে, যা এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। এমন ৩২টি দল রয়েছে, যারা জৈব প্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশল নিয়ে গবেষণা করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বহু উদ্ভাবন এখন সরাসরি শিল্প খাতে প্রয়োগ হচ্ছে।
ইংল্যান্ডের নিউ ব্রাইটনের একটি গ্রিনহাউসে উৎপাদন করা হচ্ছে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে তৈরি এ উচ্চ আঁশযুক্ত গম। ছবি: রয়টার্স
ইংল্যান্ডের নিউ ব্রাইটনের একটি গ্রিনহাউসে উৎপাদন করা হচ্ছে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে তৈরি এ উচ্চ আঁশযুক্ত গম। ছবি: রয়টার্স
বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান বায়োইকোনমি জানাচ্ছে, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে উদ্ভাবিত নতুন প্রাণ শিল্প খাতে এখন পর্যন্ত যে অবদান রেখেছে, তা অর্থনৈতিক বিবেচনায় ব্যাপক। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশই এসেছে এ গবেষণার হাত ধরে। শুধু ওষুধ ও কৃষি খাত থেকেই যথাক্রমে এসেছে ১৩ হাজার ৭০০ ও ১০ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এ দুটির খবরই মানুষ কমবেশি রাখে। কিন্তু শিল্প খাতে এ অবদান আরও বেশি। শিল্প খাতে জৈব প্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশলের অবদান ১৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।
সংকট কোথায়
জৈব প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রয়োগের সম্ভাব্য সূত্রটিও রয়েছে ইতিহাসের মধ্যে। আধুনিক বিশ্বায়িত কাঠামোর যাত্রাটি শুরু হয়েছিল কমবেশি ষোড়শ শতক থেকে। ওই শতকে বিশ্বের এক প্রান্তের সঙ্গে আরেক প্রান্তের সংযোগই শুধু ঘটেনি; আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল পোষা প্রাণী থেকে শুরু করে নানা জাতের নানা বৈশিষ্ট্যের আবাদযোগ্য ফসলও। এই বিস্তৃতি নিঃসন্দেহে নয়া কৃষিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। সারা বিশ্বের মানুষের খাদ্যতালিকায় এনেছিল ইতিবাচক পরিবর্তন। জন্ম নিয়েছিল এক বিশ্বায়িত কৃষিব্যবস্থার। কিন্তু এই সম্প্রসারণ একই সঙ্গে দুর্যোগও বয়ে আনে। কারণ, ফসলের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বায়িত হয়েছিল রোগও। হাম, গুটিবসন্তের মতো রোগের বিস্তার ঘটেছিল এই সময়েই, যাতে বহু জনপদ উজাড় হয়ে যায়। আর এই দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে দুর্বল হয়ে পড়া অঞ্চলগুলোয় সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল ইউরোপীয়রা।
ঠিক একই ধরনের বিপদ হতে পারে জৈব প্রযুক্তি থেকে। শক্তিশালী দেশগুলো চাইলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারে কৃত্রিমভাবে তৈরি জীবাণু, যা ডেকে আনতে পারে মহামারি। এই আশঙ্কা নিশ্চিতভাবেই বড় চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, যুদ্ধবাজেরা কেন শুধু শুধু জৈব প্রযুক্তির শরণাপন্ন হবেন, যখন তাদের হাতে রয়েছে পরমাণু অস্ত্র। বরং এর মাধ্যমে আরও শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথাটি হচ্ছে, এই জৈব প্রযুক্তি ভবিষ্যতে কতটা ইতি-নেতির কারণ হবে, তা বিশ্বের শাসকদের ওপরই নির্ভর করছে।
এক আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা
মানুষ যেদিন থেকে অন্য প্রাণীকে পোষ মানাতে শিখল, ইচ্ছামতো ফসল ফলাতে শিখল, সেদিন থেকে মানবসমাজেও এল বড় পরিবর্তন। উৎপাদনব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পাল্টে গেল মানুষে মানুষে সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কের নয়া রূপ ও সামাজিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের হাত ধরেই প্রয়োজন হলো নতুন কাঠামোর, যা আজকের শহর, রাষ্ট্র তথা পুরো বিশ্বকাঠামোর ছকটি অলক্ষ্যে এঁকে দিয়েছে। এই পুরো উৎপাদনপ্রক্রিয়া ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটিই মূলত গোটা শাসনকাঠামোর নির্মাতা। জৈব প্রযুক্তির বিকাশ ঠিক এমনই আরেক নতুন ছকের দিকে নিয়ে যাচ্ছে মানুষকে। কারণ, এই প্রযুক্তি জ্বালানি, খাদ্য, চিকিৎসা, শিল্পোৎপাদনের ধরনটিই পাল্টে দেবে। এমনকি এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে মানুষ নিজেকেই নিজে উৎপাদন করতে পারবে হয়তো। মানুষ চাইলে হয়তো আরও বেশি শক্তিশালী, আরও বেশি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারবে। এমনকি সুখের পেছনে ছোটা মানুষ নিজের দুঃখবোধটিকেই জিন সম্পাদনা করে মুছে দিতে পারে। ফলে এই জৈব প্রযুক্তি একেবারে নতুন এক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখান থেকে হয়তো একেবারে নতুন সমাজকাঠামোই তৈরি হয়ে যেতে পারে। বদলে যেতে পারে বিশ্ব রাজনীতি, শাসনকাঠামো থেকে শুরু করে সবকিছু।
–
প্রথমআলো থেকে সংগ্রহিত