ডিজিটাল জ্বালানি খাত: বদলে দিতে পারে অনেক কিছু
পান্থ রহমান:
সম্ভবত ২০০৯, ইউরোপের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে বহরটা। ব্যাপারটা পিকনিকের মতো।
সাংবাদিকদের বৈশ্বিক একটা জমায়েত শেষে একদিনের বেড়ানোর আয়োজন। দুটো দ্রুত গতির বাস আগে-পিছে করে চলছে। আমি সামনেরটায়। এর আগে এমন লম্বা সফরের অভিজ্ঞতা থাকলেও, এ ধরনের সত্যিকারের দূরপাল্লার যাত্রা-অভিজ্ঞতা কম। পথে ঝৈ-ঝামেলা নেই, মসৃন যাত্রা। চারপাশে জনমানুষ কম, বলা যায় হাতে গোনা। বেশ ক’মাইল পরপর দু’একটা বাড়ি এতিমের মতো তাকিয়ে আছে। তবে নিয়মিত দেখা পাওয়া যাচ্ছে গাড়ির জ্বালানি নেওয়ার পাম্প।
তেলের পাম্প বলায় আবার বাংলাদেশের পাম্পগুলোর সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। ও-গুলোকে তেলের পাম্প না বলে রেস্টুরেন্ট কিংবা বিশ্রামাগার বলাই ভাল, যেখানে জ্বালানি নেওয়ার সুযোগ আছে।
… এক দশকের বেশি সময় আগের এই গল্পটায় যে ক’টা রিফুয়েলিং স্টেশনে থামতে হয়েছিল তার বেশির ভাগেই জ্বালানি ভরে দেওয়ার জন্য কোন মানুষ ছিল না। গাড়ি থামছে, ড্রাইভার নিজেই স্টিয়ারিং থেকে নেমে প্রয়োজন মতো জ্বালানির পরিমান লিখে দিচ্ছেন, যন্ত্রটি হিসেব কষে তাৎক্ষণিক তার টাকার অঙ্ক জানিয়ে দিচ্ছে। ক্রেডিট কার্ডে সেই অর্থ পরিশোধের পর ড্রাইভার নিজেই হাতে নিচ্ছেন রিফুয়েলিংয়ের যন্ত্রটা। গাড়িতে জ্বালানি ঢুকিয়ে নিচ্ছেন। এক ফোঁটা কম বা বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। যন্ত্রটি টাকার অঙ্ক বিবেচনায় পাইপাই বুঝিয়ে দিচ্ছে জ্বালানি তেল। ব্যস, এতটাই সহজ। অবশ্য এ জমানায় এসে এ গল্পটা বলে আর কাউকে চমকে দেওয়ার সুযোগ নেই। অনেক দেশই মানুষবিহীন তেলের পাম্প চালাচ্ছে।
তবে সম্ভববত গল্পটা বাংলাদেশে চলবে। কেননা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখনও জ্বালানি খাতের এ পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে পারেনি।
২.
যদ্দুর জানা আছে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সম্পূর্ণটাকে ডিজিটাইজড বা আধুনিকায়ন করার চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে বেশ কিছু প্রকল্পের গল্প শুনেছিলাম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর মুখে। কোন এক বক্তৃতায় তিনি বলছিলেন, সবকিছু ডিজিটাল করে ফেলার লক্ষ্যের কথা। কিছু কিছু জায়গায় তার কথার সত্যতাও মিলেছে। এই যেমন প্রিপেইড বিদ্যুৎ। ঢাকার বেশ কয়েকটা এলাকার মানুষ এখন আগে পয়সা দিয়ে বিদ্যুৎ কেনেন।
যাদের কাছে বিষয়টা নতুন লাগছে তাদের জানাচ্ছি, কিছুদিন আগে মোবাইলে রিচার্জ করার জন্য আপনাদের যে কার্ড কিনতে হতো, প্রিপেইড বিদ্যুৎ কার্ডটা অনেকটা সে রকম। আগে টাকা দিয়ে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে, নির্দিষ্ট পরিমানে বিদ্যুৎ কিনে নিতে হয়। আর যখন টাকার পরিমান শেষ হয়ে যায়, বিদ্যুৎ বন্ধ! ঠিক, মোবাইলের রিচার্জের মতো। বিষয়টি এতটাই সহজ।
যদি অন্য কোন সমস্যা না থাকে তাহলে বলে ফেলা যায় যে, প্রিপেইড বিদ্যুৎ কার্ড অনেক ঝামেলা কমিয়ে দিয়েছে। সাথে কমিয়েছে বিদ্যুৎ চুরিও। এখন আর বিদ্যুতের লাইনম্যান বা মিটার রিডারের দৌরাত্ম দেখতে হচ্ছে না। মিটার রিডারের ইচ্ছের বলি হয়ে ভৌতিক বিলও গিলতে হবে না আপনাকে। আর আমার মতে সবচে বড় কাজটি হয়েছে অন্যত্র। এই পদ্ধতি শুরু হওয়ার পর বিদ্যুতের ব্যবহারেও মানুষ একটু বেশিই সচেতন হয়েছেন। ধরে নিচ্ছি প্রিপেইড বিদ্যুতের গ্রাহকরা যার যতটুকু বিদ্যুৎ প্রয়োজন, তিনি ততটুকুই ব্যবহার করছেন। কেননা অতিরিক্ত ব্যবহারে তার নিজের ব্যালেন্স শূন্য হওয়ার শঙ্কা থাকছে।
অথচ এই কাজটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সর্বত্র করে ফেলা সম্ভব, সব ক্ষেত্রেই একইভাবে ভোগান্তি কমিয়ে ফেলা সম্ভব। সাশ্রয় করা সম্ভব।
গণমানুষের সুবিধায় তেলের পাম্প থেকে শুরু করে ঘরোয়া বা কারখানার গ্যাস বা জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি অবলম্বন করা কঠিন কিছু নয়। সব মিলিয়ে গোটা খাতকে ডিজিটাল পর্দায় ছেঁয়ে দিতে পারলে প্রাতিষ্ঠানিক বা বড় কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারকেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। তাতে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, অন্যদিকে কমে আসবে সরকারের ভর্তুকির পরিমানও।
কোন এক জ্বালানি বিশেষজ্ঞের এক লেখায় পড়েছিলাম, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে তিন মাসের চুরি ঠেকানো গেলে পরের বছরের জ্বালানি মজুদ করা সম্ভব!’
বিষয়টির সত্যতা জানা নেই। তবে সবশেষ হিসেব বলে প্রতি বছর অন্তত ১১ শতাংশ পদ্ধতিগত লোকসান যার বেশিরভাগই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অপচয়। সেই অপচয়ের একটা বড় অংশই চুরি হয়! ডিজিটাইজড করে ফেলা গেলে চুরির মাত্রা কমিয়ে ফেলা যাবে। এটা আশার কথা।
৩.
প্রশ্ন হল, একথা গুলো কী সংশ্লিষ্টদের জানা নেই? যদি থেকে থাকে তাহলে দেশজুড়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর জোয়ারের মাঝেও কেন বিদ্যুৎ খাত পিছিয়ে? অথবা বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের ডিজিটালকরণে অনাগ্রহ কেন?
এটা নিয়ে সুশিলয় নিন্দুকেরা খুব একটা মুখ খোলেন না। আর কট্টর নিন্দুকেরা তো পার্টিজান, তারা আবার আলোচনা-সমালোচনার ফাঁকে এক চেটিয়া দুর্নীতি খোঁজেন। তবে শুনতে পাওয়া যায়, ভাগবাটোয়ারার ‘উইন-উইন’ অবস্থানের কারণেই ডিজিটালকরণে আগ্রহী নন ওপরওয়ালারা। ভাববেন না এই ওপর ওয়ালাদের সবাই রাজনৈতিক। বরং এদের অনেকেই রাজনীতিক না হয়েও ‘রাজনীতির সুবিধাভোগী’! তাদের কারণেই ডিজিটালকরণে আগ্রহ কম বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। আর তাই সর্বোচ্চ মহলে ব্যাপক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বেশিদূর আগায়নি এই খাতের ‘ডিজিটালকরণ’।
৪.
কিন্তু এটা এখন সময়ের দাবি। হতেই হবে, হবেও। ক’টা দিন আগে আর পরে। যাদের স্বার্থ নষ্ট হতে পারে বা স্বার্থে আঘাত (পড়ুন প্রাপ্তির পরিমান কমতে পারে) হতে পারে তারা ওটা সহসা হতে দিতে চাইছেন না। হতে দিতে চাইবেনও না, এটা নিশ্চিত। কিন্তু গোটা কয়েক মানুষের স্বার্থ’র চেয়ে নিশ্চিত করেই সামষ্টিক স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ। সেই বুঝটুকুও আমাদের সবার আছে। এটা বিশ্বাস। আমাদের সবকিছু তো বিশ্বাসের ওপরই চলছে। এক্ষেত্রেও না হয় একটু বিশ্বাস রাখলেন!
পান্থ রহমান
সভাপতি
ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (ডিক্যাব)