দেশেই তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের উঁচু টাওয়ার

কাজী মনজুর করিম মিতুল:

পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসে যখন এপার-ওপার যুক্ত হলো, তখন গোটা বিশ্ব বাংলাদেশের জয়-জয়কার করেছে। বিশ্বের গভীরতম পাইলিং ছাড়াও এই সেতু অনেক দিক দিয়েই অনন্য। দেশের দীর্ঘতম সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে রীতিমতো চমকে দেয়া হয়েছে।
উন্নয়নশীল দুনিয়ায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতও তেমনই স্বাক্ষর রেখে চলেছে। অল্প সময়ে ঈর্ষণীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি দেশেই তৈরি হচ্ছে সঞ্চালন টাওয়ার।
১৩২, ২৩০, ৪০০ কিলোভোল্ট (কেভি) থেকে এখন বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিচ্ছে ৭৬৫ কেভি লেভেলের সঞ্চালন লাইন তৈরির জন্য।
একটা সময় ছিল, যখন এসব লাইন নির্মাণের জন্য স্টীলের গ্যালভানাইজড টাওয়ার আমদানি করতে বাংলাদেশ মুখাপেক্ষী ছিল কোরিয়া, চীন ও ভারতের ওপর। যেমনটা এখনও নির্ভর করতে হয় কন্ডাকটর (বিদ্যুতের তার) ও আনুষঙ্গীক যন্ত্রের জন্য। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) গত ১০ বছরে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে যত সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করেছে, তার অনেকটাই বিদেশি ঠিকাদাররা দেশি টাওয়ার কিনে লাইন নির্মাণ করেছেন।
বরিশাল থেকে নদী গর্ভে টাওয়ার বসিয়ে ভোলা পর্যন্ত ২৩০ কেভি লাইন, ঈশ্বরদী সাবস্টেশন থেকে রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট পর্যন্ত ১৩২ কেভি লাইন, আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ভুলতা সাবস্টেশন পর্যন্ত ৪০০ কেভি লাইন, পটুয়াখালী সাবস্টেশন থেকে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাকফিড পাওয়ার দেয়ার জন্য ২৩০ কেভি লাইন, এমনকি পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে গোপালগঞ্জ উপকেন্দ্র পর্যন্ত ৪০০ কেভি লাইনের টাওয়ার নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশেই।
এছাড়াও মেঘনা নদীর ওপর দিয়ে আরও একটি ২৩০ কেভি লাইনের জন্য কোরিয়ার হ্যানবেক কোম্পানির নকশা করা (যেখানে পিজিসিবি-নকশা বিভাগের অবদানও রয়েছে) টাওয়ারটি ১৭৫ মিটার উচ্চতার। এটা দেশের দ্বিতীয় উচ্চতম টাওয়ার। আশুগঞ্জ-ভুলতা ৪০০ কেভি লাইনের টাওয়ার হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের উচ্চতম টাওয়ার ছিল এটি। ৪০০ কেভি লাইনের টাওয়ারটি ভারতীয় কেইসি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (আরপিজি গ্রুপ) এর নকশা করা। এখানেও রয়েছে পিজিসিবি’র নকশা বিভাগের অভিজ্ঞতা, মেধা এবং কঠোর পরিশ্রম। উল্লেখিত দুটি টাওয়ারই বাংলাদেশের কনফিডেন্স স্টিল লিমিটেডের তৈরি।
বাংলাদেশ এখন একথা বলে গর্ব করতেই পারে যে, দেশের উচ্চতম টাওয়ার ১৮৪ মিটার বা প্রায় ৬০৪ ফুট, যা মেঘনা নদীর ওপর দিয়ে আশুগঞ্জ থেকে ভুলতায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন করছে, তা বাংলাদেশেই তৈরি।
বর্তমানে তিনটি দেশি কোম্পানি বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগের জন্য উচ্চক্ষমতার স্টিল টাওয়ার তৈরি করছে। কোম্পানিগুলো হলো-কনফিডেন্স গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান কনফিডেন্স স্টিল লিমিটেড বা ‘কনফিডেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার’, আজিম গ্রুপের ‘গ্লোবাল স্টিল লিমিটেড’ এবং ’আটলান্টা স্টিল লিমিটেড’। সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পের জন্য টাওয়ার তৈরি করছে তারা।
কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের আওতায় পিজিসিবির বর্তমান ১৩২ কেভি লাইন স্থানান্তরসহ নতুন একটি লাইন দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণ করছে পিজিসিবি। সেখানে টার্ন কী ঠিকাদার কনফিডেন্স স্টিল (দোহাজারি-চকরিয়া) এবং বেসিক-দেশ (আটলান্টা) যৌথ উদ্যোগ (চকরিয়া-কক্সবাজার)। এসব ঠিকাদার দেশি হওয়ায় করোনা মহামারি সত্ত্ব্যেও প্রকল্পের কাজ খুব বেশি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না।
ভারতের রোহানপুর থেকে আমদানিতব্য বিদ্যুৎ রোহানপুর থেকে মোনাকশা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) উপকেন্দ্র পর্যন্ত সঞ্চালনের জন্য ৪০০ কেভি লাইন নির্মাণ করছে ভারতের ট্রান্সরেইল লাইটিং লিমিটেড। প্রকল্পটি পিজিসিবির আওতাধীন। এর জন্য টাওয়ার তৈরি করছে বাংলাদেশের গ্লোবাল স্টিল লিমিটেড।
বর্তমানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে আমিন বাজার থেকে পদ্মার ওপর দিয়ে মোংলা পর্যন্ত যে ৪০০ কেভি লাইন নির্মিত হচ্ছে, তার আমিন বাজার থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত অংশের ৭৪ কিলোমিটার নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশের টাওয়ার দিয়ে। যার ঠিকাদার চীনা ও বাংলাদেশি যৌথ কোম্পানি। গোপালগঞ্জ-মোংলা অংশের টাওয়ার আসবে ভারত থেকে। এর ঠিকাদারও ভারতীয়।
শুধু পিজিসিবির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনই নয়, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড দেশের গ্রামাঞ্চলে নদীর ওপর দিয়ে যেসব ৩৩ কেভি বিতরণ লাইন নির্মাণ করছে, সেগুলোর ৩৭টি লাইনের ‘টার্নকী’ ঠিকাদার কনফিডেন্স স্টিল। বেসিক-দেশ (আটলান্টা) কাজ করছে এমন ৫২টি লাইনের টার্নকী ঠিকাদার হিসেবে।
বিদেশি টার্নকী ঠিকাদাররা দেশি টাওয়ার দিয়ে লাইন নির্মাণ করায় বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। অন্যদিকে নির্মাণ কাজ চলাকালে কোন জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত সমাধান করা যাচ্ছে।
বিদেশি টাওয়ার উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে শুধু দামই নয়, মানের দিক দিয়েও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকে আছে। এগিয়ে যাচ্ছে।
টাওয়ার উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন, বিদেশি ঋণদাতা সংস্থা চেষ্টা করে তাদের নিজের বা পছন্দের দেশ থেকে টাওয়ারসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে। ঋণচুক্তিতে এমন কিছু শর্তও জুড়ে দেয়া হয়। দেশের অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। অভ্যান্তরিণ পণ্য নেয়ার সুবিধা থাকে কোন কোন দরপত্রে, অনেক ক্ষেত্রে তা থাকেই না। আর থাকলেও বিদেশ থেকে আমদানি করা টাওয়ারের জন্য কিছু কর ও শুল্ক রেয়াত সুবিধা দেয়া হচ্ছে যা দেশি টাওয়ারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ফলে দেশি টাওয়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিদেশিদের সাথে এক অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পে যেমন বড় আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রেখেছে, ক্রিকেটে যেমন গোটা বিশ্বের কাছে সমীহের পাত্র, তেমনই স্টিল টাওয়ার উৎপাদনেও এশিয়ার এক পরাশক্তি হিসেবে অচিরেই দৃঢ় অবস্থানে চলে আসতে পারে। আর সেটা বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন সরকারের আন্তরিকতা। বিদেশিদের সাথে ঋণচুক্তির সময় দেশি শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা করার যৌক্তিক কিছু শর্ত দেয়া উচিত। এতে যেমন দেশের টাওয়ার দিয়েই দেশের উন্নয়ন হবে তেমন হবে কর্মসংস্থান। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মধ্যদিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে স্টিল টাওয়ার শিল্প। আর তা দেশের প্রবৃদ্ধির জন্য হবে অনন্য এক ঈর্ষণীয় মাইলফলক।
বিদ্যুৎ খাতে গত কয়েকবছরের সাফল্য অভাবনীয়। শহরে এখন মানুষ লোডশেডিং এর নাম ভুলে গেছে। গ্রামেও লেগেছে যাদুকরি পরশ। পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়া যেমন সুলভ ও সহজ হয়েছে, তেমনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থাও অনেক উন্নত।
‘শতভাগ বিদ্যুতায়ন’ এখন দোরগোড়ায়। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে হয়েছে ২৩ হাজার ৭৭৭ মেগাওয়াট। দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রর সংখ্যা ১৪০। আরও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। ২০৪১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৬০ হাজার মেগাওয়াট। গত দশ বছরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন। বর্তমানে ১২ হাজার ৪৪৪ কিলোমিটার লাইন সচল আছে।
সব সঞ্চালন লাইনের টাওয়ার একসময় দেশেই তৈরি হবে এমন আশা সংশ্লিষ্ঠদের।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও প্রকৌশলী