নেপাল এখন ধ্বংসস্তূপ: নিহত দুই হাজার, বাড়ছে লাশ
নেপালে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা দুই হাজার ২০০ ছাড়িয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসস্তূপে এখনো অনেকে আটকা পড়ে আছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নেপাল পুলিশ জানিয়েছে, শনিবারের এই ভূমিকম্পে আহত হয়েছেন অন্তত চার হাজার ৭০০ জন। রাজধানী কাঠমাণ্ডুতেই অন্তত চারশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেখানে ধ্বংসস্তূপে অনেক জীবিত বা মৃত মানুষ আটকা পড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবমিলে প্রাণহানির সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া ভবনগুলোর থেকে আটকে পড়াদের আর্তনাদের মাঝে নেপালে রোববার নতুন করে ভূপিকম্পের শক্তিশালী পরাঘাত হয়েছে। কম্পন অনুভূত হয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশেও। এভারেস্টে আরো তুষারধসের খবর পাওয়া গেছে।
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ৬০ কিলোমিটার পূর্বে ৬ দশমিক ৭ মাত্রার এ পরাঘাত অনুভূত হয়। লোকজন আতঙ্কে শহরের খোলা জায়গায় গিয়ে জড়ো হয়।
আগের দিন ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানী কাঠমান্ডুসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু ভবন ধসে পড়েছে, এর মধ্যে বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত ধারারা টাওয়ারসহ অনেক পর্যটন কেন্দ্রও রয়েছে।
হিমালয় পর্বতমালায় ব্যাপক তুষার ধস হয়েছে। এতে অন্তত ১৮ পর্বতারোহীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এই সংখ্যাও আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শনিবারের ভূমিকম্পে ভারতে অন্তত ৫২ জন, তিব্বতে ১৭ জন এবং বাংলাদেশে চার জনের মৃত্যু হয়।
ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে নেপাল সরকার। উদ্ধারকাজে আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়েছে দেশটি।
বুলডোজারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে রাতভর উদ্ধার কার্যক্রম চালান উদ্ধারকর্মীরা। রোববার সকালে উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করা হয়।
নেপালের হাসপাতালগুলোতে আহতদের উপচে পড়া ভিড়। তাদের সামলাতে রীতিমত লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও সহযোগীদের।
রোববার আরো নতুন রোগী আসার সম্ভাবনা থাকলেও এরইমধ্যে চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট দেখা দিয়েছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
কাঠমাণ্ডুর বীর হাসপাতালে শনিবার তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে দীনেশ চৌধারী নামে এক চিকিৎসক জানান।
তিনি বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হয়।
“রোববার আরো অনেক রোগী আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এখন পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপের ক্ষুদ্র অংশ সরানো হয়েছে।”
রাতে বেশ কয়েক দফা শক্তিশালী পরাঘাতে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতিতে মহাসড়কে যান চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় এবং সরঞ্জামের অভাবে উদ্ধার কর্মীরা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়।
এতে বলা হয়, অনেক জায়গায় আটকে পড়াদের সন্ধানে ধ্বংসস্তূপের ভিতরে খালি হাতে তল্লাশিতে নেমেছেন লোকজন।
হাড়কাঁপানো শীত ও বৃষ্টির মধ্যে রাতে রাজধানীতে কয়েক হাজার মানুষ ঘরের বাইরে অবস্থান নেওয়ায় তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খায় কর্তৃপক্ষ।
রামেশ্বর ডঙ্গল নামে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, তাঁবু টাঙিয়ে এবং স্কুল ও অন্যান্য সরকারি ভবনে মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
সড়ক-মহাসড়ক যান চলাচলের উপযোগী করতে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি উদ্ধার তৎপরতায় হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ইউএস জিওলজিকাল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পোখারা থেকে ৫০ মাইল পূর্বে ভূপৃষ্ঠের মাত্র ২ কিলোমিটার গভীরে ছিল এই ভূমিকম্পের কেন্দ্র।
ভূপৃষ্ঠের অল্প গভীরে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো উদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়নি।
ভূমিকম্পে কাঠমান্ডুতে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের স্থান ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্য ধারারা টাওয়ারও ধসে পড়েছে।
১৮৩২ সালে রানির জন্য নির্মিত এই স্থাপনার চূড়ার বেলকনিটি ১০ বছর আগে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
৬০ মিটার উচ্চতার টাওয়ারটি এখন ১০ মিটার উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে অনেকের মরদেহ বের করে আনা হয়েছে। দুইশ’র মতো মানুষ সেখানে আটকা পড়েছিলেন বলে এক পুলিশ সদস্য জানিয়েছেন।
শহরজুড়ে বহু পুরোনো কাঠের মন্দিরসহ বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরানোর চেষ্টা করছেন উদ্ধার কর্মীরা।
“একটি আশ্রমের কাছে ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে তিনজন সন্ন্যাসীর মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেছি আমি। আমরা তাদের বের করে আনার চেষ্টা করছি এবং অন্য কেউ আটকে আছে কি না তা খুঁজে দেখছি,” দেবযানী পান্থ নামে এক ভারতীয় পর্যটক রয়টার্সকে বলেছেন।
পর্যটনের জন্য সুপরিচিত দেশ নেপালে ভূমিকম্পের সময় তিন লাখ বিদেশি অবস্থান করছিলেন বলে দেশটির পর্যটন মন্ত্রণালয় জানায়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর পর্বতারোহী একটি দল এভারেস্টে ১৮টি মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে।
ভূমিকম্পে ধসের কারণে এভারেস্টের বেইজ ক্যাম্পের কিছু অংশ বরফের নিচে চাপা পড়েছে বলে নেপালের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জ্ঞানেন্দ্র শ্রেষ্ঠা জানিয়েছেন।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের সময় অন্তত এক হাজার পর্বতারোহী (যাদের মধ্যে প্রায় চারশ জন বিদেশি) বেইজ ক্যাম্প বা এভারেস্টের চূড়ার পথে ছিলেন।
অ্যালেক্স গ্যাভান নামে রোমানিয়ান এক পর্বত আরোহী এক টুইটে লিখেছেন, ‘শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর বড় ধরনের তুষার ধস’ হয় বেইজ ক্যাম্পে। জীবন বাঁচাতে দৌড় শুরু করেন তিনি।
পরের এক টুইটে আহতদের উদ্ধারে হেলিকপ্টার পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন তিনি।
“অনেকে মারা গেছেন। গুরুতর আহত অনেকে। হেলিকপ্টার না এলে আরো মারা পড়বে।”
নেপালের দুর্গতদের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়েছে বিভিন্ন দেশ।
ভারত এরই মধ্যে তিন টন ত্রাণ ও ৪০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধারকর্মী নেপালে পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মীদের একটি দল নেপালের পথে রওয়ানা হয়েছে। এছাড়া জরুরি সাহায্যের জন্য প্রাথমিকভাবে ১০ লাখ মার্কিন ডলার অর্থ সাহায্য দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।
যুক্তরাজ্যের প্রাধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ভূমিকম্প দুর্গতদের সাহায্যে ‘সব কিছু করার’ ঘোষণা দিয়েছেন। সাহায্য ও সহায়তার যেকোন ধরণের অনুরোধে সাড়া দিতে ফ্রান্স প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ। নেপাল কর্তৃপক্ষকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পাকিস্তান।
বাংলাদেশ সরকার উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণসহ চিকিৎসা ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
নেপালে এর আগে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ভূমিকম্পে, ওই দুর্যোগে সাড়ে ৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।