বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা

জনেন্দ্র নাথ সরকার:

শিল্প, কৃষি, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিনোদনসহ প্রায় প্রতিটি আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকার কারণে জ্বালানি বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ জনসাধারণের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ উপলব্ধি থেকে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জ্বালানিখাতকে অধীক গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
দেশ স্বাধীনের মাত্র দুই মাস ষোল দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু জ্বালানিখাত উন্নয়নের জন্য ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্টের আদেশ বলে নিজস্ব ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ মিনারেল, অয়েল এন্ড গ্যাস করপোরেশন (বিএমওজিসি) প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে ঐ করপোরেশনই হয়েছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন, যা সংক্ষিপ্তভাবে পেট্রোবাংলা নামে পরিচিত।
পাঁচ দশকের পথ পরিক্রমায় বর্তমানে পেট্রোবাংলা ১৩টি কোম্পানির মাধ্যমে তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, উন্নয়ন, সঞ্চালন এবং বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ আদেশের মাধ্যমে তিতাস গ্যাস টিএন্ডডি কোম্পানি’র মালিকানাস্বত্ত্ব সরকারের অধীনে আনেন। উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি)-এর আওতায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির অনুসন্ধান কার্যক্রমে অংশ নেয়া সহজ করার জন্য ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম আইন ১৯৭৪’ করেন।
এই আইনের অধীনে অগভীর সমুদ্রাঞ্চলকে ছয়টি ব্লকে ভাগ করে ছয়টি কোম্পানির সাথে পিএসসি করা হয়।
এ্যাশল্যান্ড, আরকো, বিওডিসি (জাপেক্স), ইউনিয়ন অয়েল, কানাডিয়ান সুপিরিয়র অয়েল ও ইনা নাফটাপলিন এর সাথে চুক্তি করা হয়। এতে কুতুবদিয়া গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কার হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর সাথে পিএসসি এবং বিবিয়ানাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়। যা জ্বালানি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে আলজেরিয়া সফরের সময় সে দেশের কারিগরি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। তাঁর উদ্যোগের ফলে পেট্রোবাংলা’র ৪০ জন কর্মকর্তাকে তেল ও গ্যাস বিষয়ে শিক্ষা লাভের জন্য আলজেরিয়া সরকার বৃত্তি (গ্রাজুয়েশন ও এডভান্সড ডিপ্লোমা ডিগ্রী) দেন। যা এখাতে মানব সম্পদ উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করে।
এ অঞ্চলে ১৯০৮ সাল থেকে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হলেও ১৯৭২ সালের আগ পর্যন্ত মাত্র ২৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়। এই ২৮টি কূপ খনন করে ৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার হয়। এরমধ্যে ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র যথা: তিতাস, হবিগঞ্জ, কৈলাশটিলা, রশিদপুর ও বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে তৎকালীন মোট মজুদের সিংহভাগ সঞ্চিত ছিল। এই ৫টি গ্যাসক্ষেত্র বিশ্বখ্যাত শেল অয়েল কোম্পানির মালিকানা ও আওতায় পরিচালিত হতো।
অতুলনীয় দূরদর্শিতার অধিকারী নেতা বঙ্গবন্ধু, ১৯৭৩ সালের বিশ্বব্যাপী বিরাজমান অর্থনৈতিক মন্দা ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি চলমান থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৯ই আগস্ট ঐ ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র ৪ দশমিক ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং-এ ক্রয় করে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। এ চুক্তি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য একটি মাইলফলক।
চুক্তির নির্ধারিত অর্থের প্রথম কিস্তি ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে পরিশোধ শুরু হয়। অর্ধবার্ষিকীতে মোট ১৮ কিস্তিতে ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুরো অর্থ শোধ হয়।
ক্রয়কালীন সময়ে ঐ ৫টি গ্যাস ক্ষেত্রের মোট গ্যাসের মজুদ ৫ দশমিক ৫৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) ধরা হয়েছিল। শেষ পুনর্মূল্যায়নে এই ৫টি গ্যাস ক্ষেত্রের মোট গ্যাস মজুদ প্রাক্কলন করা হয় ১৫ দশমিক ৫৮ টিসিএফ। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞায় জাতি ১৯৭৫ সালের ৯ই আগস্ট ৫টি গ্যাসক্ষেত্র নিজস্ব সম্পদে পরিণত করে। এতে তৎকালীন চুক্তি মূল্য বাবদ ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়।
১৯৭৫ সালের ৯ই আগস্ট থেকে জুন, ২০২৩ পর্যন্ত ঔ গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে ১০ দশমিক ২৬ টিসিএফ গ্যাস উৎপাদন করা হয়েছে। বর্তমান বিক্রয় মূল্যের হিসাবে যার আর্থিকমূল্য প্রায় ৬ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। ৪৮ বছর ব্যবহারের পরেও (জুলাই, ২০২৩) মজুদ অবশিষ্ট আছে ৫ দশমিক ২৩ টিসিএফ। যার বর্তমান আর্থিক মূল্য প্রায় ৩ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকায় কেনা গ্যাসক্ষেত্রর এখন পর্যন্ত হিসাবে মূল্য দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া অতীতের মতো বর্তমানেও দেশে স্বল্পমূল্যে যে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে, তাও সেদিন করা চুক্তির অন্যতম সফলতা।
এ ৫টি গ্যাসক্ষেত্র যখন কেনা হয়েছিল তখন শুধু তিতাস ও হবিগঞ্জ ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন হতো। ১৯৭৫ সালের ৯ই আগস্ট পর্যন্ত এ দু’টি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে মোট ৮৬ দশমিক ৪৭২ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হয়। সে সময়ে ৬টি (তিতাস-৪, হবিগঞ্জ-২) কূপ থেকে দৈনিক ৬২ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উত্তোলন হলেও বর্তমানে ৪৪টি (রশিদপুর-৫, তিতাস-২৩, বাখরাবাদ-৬, কৈলাশটিলা-৩, হবিগঞ্জ-৭) কূপ থেকে কমবেশী দৈনিক ৬৩২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। যা মোট উৎপাদনের ২৯ শতাংশ। বর্তমান বাজার দরে যার আর্থিক মূল্য দৈনিক ৩৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে এপর্যন্ত ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার হয়েছে। এরমধ্যে ঐ ৫টি গ্যাস ক্ষেত্রসহ ২০টি উৎপাদনে আছে। শুরু থেকে জুন, ২০২৩ পর্যন্ত উৎপাদিত মোট গ্যাসের এক-চতুর্থাংশের বেশি তিতাস গ্যাস ক্ষেত্রে উৎপাদন করা হয়েছে। এই ২৯টি ক্ষেত্রে বর্তমানে (জুলাই, ২০২৩) অবশিষ্ট মজুদ আছে ৮ দশমিক ৪৬ টিসিএফ গ্যাস, যার মধ্যে ৫ দশমিক ২৩ টিসিএফ আছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিজড়িত ৫টি গ্যাসক্ষেত্রে।
এই ৫টি গ্যাসক্ষেত্র বাংলাদেশের মালিকানায় আনার ফলে বহুজাতিক শেল ওয়েল এর সাবসিডিয়ারী দ্যা শেল কোম্পানি অব পাকিস্তান লিমিটেড এর আওতামুক্ত হয়। এবং বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস্ কোম্পানী লি. (বিজিএফসিএল) নামে গ্যাস উৎপাদনের নতুন দিগন্ত সূচনা করেন। পরবর্তীকালে বড় পরিসরে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের জন্য পেট্রোবাংলার গ্যাস অনুসন্ধান পরিদপ্তরকে আলাদা করে দেশের একমাত্র অনুসন্ধান ও উৎপাদন কোম্পানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানী লি. (বাপেক্স) গঠিত হয়। যা বঙ্গবন্ধুর নেওয়া সেই উদ্যোগের ধারাবাহিকতা।
বাংলাদেশে গ্যাসখাতে বর্তমান অবকাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্ধন এবং প্রাথমিক জ্বালানি, গ্যাস নির্ভর যে সকল বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়েছে ও ভবিষ্যতে করা হবে তার বীজ মূলতঃ সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে অঙ্কুরিত হয়েছিল। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় বঙ্গবন্ধুর অবদান জাতি আজ পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ও ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি জ্বালানিখাতে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সাফল্যের সাথে সকল কার্যক্রম নেওয়ায় বর্ধিত হারে জ্বালানি সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে।
অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের লক্ষ্য সামনে রেখে চাহিদা ও সরবরাহের রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে। দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের পাশাপাশি এলএনজি আকারে গ্যাস আমদানির কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
শিল্প-কারখানায় জ্বালানি দক্ষ সরঞ্জাম সংযোজন করার জন্য পেট্রোবাংলা থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মূল্যবান জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারে সকলকে সাশ্রয়ী ও সচেতন হতে হবে। সমস্বরে বলতে চাই – ‘স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয়- জ্বালানির সাশ্রয়’।

লেখক: চেয়ারম্যান, পেট্রোবাংলা