বরাদ্দ কমছে বিদ্যুতে বাড়ছে জ্বালানিতে
আগামী বাজেটে কমছে বিদ্যুৎ খাতের বরাদ্দ, বাড়ছে জ্বালানি খাতে। তবে প্রতি বছরের মতো এবারো সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন। বাজেটের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ খরচ হবে এ খাতে। এদিকে তেলের দাম কমে যাওয়ায় বিপিসির জন্য ভর্তুকি বাবদ এবার কোনো বরাদ্দ রাখা হচ্ছে না।
আগামী অর্থবছরের বাজেটের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য মোট ১৬ হাজার ৫০৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা চলতি বছর ছিল ১৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা টাকা।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এই চাহিদা পূরণ করতে হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এজন্য আগামী বাজেটে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ খাতে প্রায় ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য বিদ্যুৎ খাতে ১৩ হাজার ৪০ কোটি ৯ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) মোট ৬৭টি প্রকল্পের আওতায় ১২ হাজার ৫৪০ কোটি ৯ লাখ এবং অনুন্নয়ন খাতে ২২ কোটি ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে মোট বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ খাতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
বাজেটে পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও কারিগরি কাজের জন্য মোট ১ হাজার ৬৭২ কোটি ৮২ লাখ টাকা, পল্লী
বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) বিদ্যুৎ বিতরণ ও কারিগরি কাজের জন্য ৩ হাজার ৮৪৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও কারিগরি কাজে ১ হাজার ৫৩৩ কোটি, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য ৪৬৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, নর্থ ওয়েস্ট জোন পাওয়ার কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১ হাজার ২৬ কোটি টাকা, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশের (ইজিসিবি) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪০১ কোটি, আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানির (এপিএসসিএল) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৭০ কোটি, ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানির (ডেসকো) বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য ২৯৫ কোটি, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) বিদ্যুৎ বিতরণে ২৫০ কোটি, সিপিজিসিএল বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২ হাজার ৫৪০ এবং সর্বশেষ বিদ্যুৎ বিভাগের কারিগরি কাজে ৪১ কোটি ৪৫ লাখ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে জ্বালানি খাতে ৩ হাজার ৪৬৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে এডিপিতে ৯৬১ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জ্বালানি খাতের মোট বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৯৯৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১ হাজার ৫৬৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে জ্বালানি খাতে।
জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে দেশে জ্বালানির যে পরিমাণ চাহিদা আছে তা পূরণ করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও জ্বালানি ঘাটতি আছে। এসব ঘাটতি পূরণ করতে হলে এ খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য এবার এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।
জানা যায়, এবারের বাজেটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও পুরনো কেন্দ্র মেরামত করাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সঞ্চালন, বিতরণ, বর্তমান লাইনের সংস্কার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি বাড়ানো, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী কার্যক্রম, লোড ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানো, সিস্টেম লস কমানো এবং রাজস্ব আয় বাড়ানোর কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি বিভাগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর ওপর। এ ছাড়া কৃষি, যোগাযোগ, শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে জ্বালানি তেলের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে গ্যাস নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও বিতরণ ব্যবস্থাপনায় সিস্টেম লস কমানো, তেল বিপণন ব্যবস্থা উন্নত করা এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানোকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে।
এদিকে এবারের বাজেটে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরে বিপিসির জন্য ভর্তুকি বাবদ ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, আগে বিপিসিকে অনেক টাকা ভর্তুকি দেয়া হতো। তারা বেশি দামে তেল কিনে তা দেশের বাজারে কম দামে বিক্রি করার কারণে তাদের এই ভর্তুকির প্রয়োজন হতো। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দীর্ঘদিন দেশীয় বাজারে সমন্বয় না করায় বিপিসি বিপুল আয় করেছে। এখন আর তাদের অর্থের সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, বিপিসি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করে এখন লাভের মুখ দেখেছে। এ কারণে আগামী অর্থবছরে বিপিসির জন্য কোনো ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হবে না।
বিপিসি সূত্র জানায়, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছর জ্বালানি তেল কেনা বাবদ ৫ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা এবং চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে ১০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে তারা।
এদিকে বাজেটে প্রতি বছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ রাখা হয় বাজেটের শেষে এসে দেখা যায় একটি বড় অংশ খরচ করতে পারেনি। চলতি অর্থবছরেও একই অবস্থা। বাজেটের ৬০ শতাংশ খরচ করেছে তারা।
চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতের এডিপির বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার ৪৮৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে বছর শেষে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় এক হাজার ৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা খরচ করতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ।
পিডিবি করেছে ৪৭ শতাংশ কাজ। এর মধ্যে নিজস্ব টাকা ৫১ ভাগ আর ঋণের ৪৫ ভাগ। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) মোট বরাদ্দের ৭১ শতাংশ খরচ করেছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) করেছে ৫৪ ভাগ। ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি) মাত্র ২৩ ভাগ, ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি (ডেসকো) ৫১ ভাগ, পাওয়ার সেল ৭৪ ভাগ, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ৫৯ ভাগ, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (নওপাজেকো) ৮১ ভাগ ও ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি) ৫১ ভাগ অর্থ খরচ করতে পেরেছে। সব মিলে ৬২ দশমিক ৯২ ভাগ অর্থ খরচ করতে পেরেছে বিদ্যুৎ বিভাগের আওতায় থাকা কোম্পানি ও সংস্থাগুলো।