বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলা এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম।
প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, কোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মানবসৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ বাংলাদেশকে তার উন্নয়নের অভীষ্ট পথ থেকে সরাতে পারবে না।
তিনি আজ বাংলাদেশ সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণকালে আরো বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সন্ত্রাস দমনে গোটা বিশ্বের উদাহরণে পরিণত হয়েছে। এখন আমাদের নিজ বলে বলীয়ান হয়ে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রকৃতি বা মানবসৃষ্ট কোনো দুর্যোগ আমাদের অগগ্রতি বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ মানে ছিলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদের মতো মানবসৃষ্ট নৈরাজ্যের এক ভয়াবহ চিত্র। আমরা এই বদনাম থেকে উতরে দেশকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে আসীন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়সমূহ পরিদর্শন কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ এই মন্ত্রণালয়ে আসেন। তিনি এখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়টির উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার পাশাপাশি তাদের কাজকর্মে গতিশীলতা আনতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কাজেই এই দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারবে না, একথা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় বার বার সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
তিনি দেশের উত্তরাঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে চাষের জন্য জমি ও নিরাপদ জীবন-যাপনের উপকরণ সরবরাহ করে তাদের পুনর্বাসনে তৎপর হতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বক্তৃতা দেন। এতে সচিব মেজবাহ-উল-আলম মন্ত্রণালয়টির বিভিন্ন কর্মকা- ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বিষয় তুলে ধরে বক্তৃতা করেন। এসময় মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ত্রাণ বিতরণের অভিজ্ঞতা থেকে স্বাধীনতার পর দেশে পৃথক ত্রাণ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। এ জন্য আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। এটিই বাস্তবতা যে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে আমাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে হবে ।
বিদেশী সাহায্য পেতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি প্রদর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি তিনি পছন্দ করেন না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সতর্কতা, পূর্ব প্রস্তুতি, দ্রুত উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বন্যা ও নদী ভাঙ্গনকে জনগণের জন্য দু’টি বড় দুর্যোগ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, নদী ভাঙ্গনে প্রতি বছর হাজার হাজার একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এতে লাখ লাখ লোক গৃহহীন হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, সরকার ৬২ হাজার আরবান ভলেন্টিয়ার্স করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ইতোমধ্যেই ২৬ হাজার ৩শ’ ১৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং তাদেরকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই ৬৪ কোটি টাকা মূল্যের তল্লাশী ও উদ্ধার যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছে। এই যন্ত্রপাতি সশস্ত্র বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স ও সিটি কর্পোরেশনকে দেয়া হয়েছে। সরকার আরো ১৫৯ কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি ক্রয় করার পরিকল্পনা করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা লাভের জন্য অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপর সম্মান ও ডিপ্লোমা কোর্স খোলা হয়েছে। ১১টি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মডেলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কোর্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত দেশ হবে।
অনুষ্ঠানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-ে সমন্বয় ও কার্যকারিতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৯ দফা প্রস্তাব পেশ করেন।
মন্ত্রী মায়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং আবহাওয়া অধিদফতরকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেয়ার প্রস্তাব করেন। এছাড়া তিনি বড় ধরনের কোন দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা এবং মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত নতুন অরগানোগ্রামের অনুমোদন দেয়ারও প্রস্তাব করেন।
১৯৯০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর চট্টগ্রামে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনাকালে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর মাঠপর্যায়ের সেই অভিজ্ঞতা দলকে কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করেছে।
১৯৯৮ সালে দেশব্যাপী বন্যার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তখন রাজধানী ঢাকা কয়েক সপ্তাহ এবং দেশের বাকি অংশ প্রায় তিন মাস বন্যার পানিতে ডুবে ছিল। তিনি উল্লেখ করেন যে, বিবিসি তখন আশঙ্কা করেছিল, ভয়াবহ এই বন্যার পরে দুই কোটি লোক অনাহারে মারা যাবে।
তবে সেনাবাহিনী, আইন-শৃংখলা বাহিনী সংস্থাসমূহ, ছাত্র-ছাত্রী, চিকিৎসক, দলীয় কর্মী ও সাধারণ মানুষ সকলে মিলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
পাশাপাশি সরকার হ্রাণ কার্যক্রম সমন্বয় করে প্রমাণ করেছে যে, বিবিসি’র আশঙ্কা ভুল। তিনি আরো বলেন, আমরা ১৯৯৮ সালে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সবচেয়ে অপরিহার্য দৃঢ় অঙ্গীকার।
শেখ হাসিনা বলেন, যথাযথ সমন্বয় এবং গতিশীল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার স্ট্রান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার (এসওডি) গঠন করে।
২০১০ সালে এই বিধি সংশোধন করে দুর্যোগকালে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িদায়িত্বের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা অর্জন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ১৯৯৭ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে। তবে পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনকালে এই প্রক্রিয়া এগোয়নি। ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে এটি আইন হিসেবে অনুমোদন করে।
তিনি বলেন, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কারণে সম্পদ ও প্রাণহানি কমে এসেছে। তিনি বলেন, ১৯৭০ সালে বন্যায় ৩ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৭ সালে অনুরূপ ঘূর্ণিঝড় সিডরে তিন হাজারের কম লোকের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা ও ২০১৩ সালে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে যথাক্রমে ১৯০ ও ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে ঘন ঘন দুর্যোগ ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের উপকূলীয় এলাকায় ৬ হাজারের বেশি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন, এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৫১টি আশয়কেন্দ্র ইতোমধ্যেই নির্মিত হয়েছে এবং ৬২৯টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।
এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বিশেষ করে সংসদ সদস্যদরকে উপযুক্ত স্থানে ঘূর্ণিঝড় আশয়কেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতার আহ্বান জানান। যাতে যে কোন দুর্যোগে জনগণ নিজেদের এলাকায় দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেন