বাংলাদেশে জ্বালানি তেল বিপণনের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষিত
বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি):
বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীনতম তেল কোম্পানি।প্রাথমিকভাবে এ কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালিত হতো বার্মায়।বিওসি ১৮৮৬ সালে নিবন্ধিত হলেও এরপূর্বে (১৮৭১-১৮৮৬) এ কোম্পানির নাম ছিল “দি রেংগুন অয়েল কোম্পানি লিমিটেড”। ১৮৭১ সালে রেঙ্গুন অয়েল কোম্পানি এডিনবরাতে নিবন্ধিত হয়।১৮৭১ সালের পূর্বে রেঙ্গুন অয়েল কোম্পানি (১৮৬৪-১৮৭১) ভিন্ন মালিকানাধীনে “দি বর্মিজ অয়েল ডিস্টিলারী লিমিটেড” নামে ব্যবসা করছিল।“দি বর্মিজ অয়েল ডিস্টিলারী লিমিটেডে(ভিন্ন মালিকানাধীনে) এর পূর্ব নাম ছিল (১৮৫৮-১৮৬৪) “সিন্ডিকেট অব ইষ্ট ইন্ডিয়া মার্চেন্টস”। বস্তুত এই “সিন্ডিকেট অব ইষ্ট ইন্ডিয়া মার্চেন্টস”ই হলো বার্মা অয়েল কোম্পানির মূল উৎস।কোম্পানির উদ্যোক্তা ও চেয়ারম্যান ছিলেন জেমস গ্যালব্রেইথ।১৮৭৬ সালে গ্যালব্রেইথ স্বেচ্ছায় রেঙ্গুন অয়েল কোম্পানির দেউলিয়াত্ব ঘোষণা করলে ডেভিড কার্গিল এটি ক্রয় করেন।
ডেভিড কার্গিল (১৮২৬-১৯০৪) স্কটল্যান্ডের আংগুস শহরে জন্মগ্রহণ করেন।তেল ব্যবসায় আসার পূর্বে কপি, চা এবং অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদির ব্যবসায় তাঁর ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা ছিল।তাঁর প্রথম ব্যবসা ছিল শ্রীলংকার কলম্বোতে।বহুবিধ প্রচেষ্টা এবং প্রশাসনিক সংস্কার সত্ত্বেও রেঙ্গুন অয়েল কোম্পানি কার্গিলের জন্য কোন অর্থনৈতিক মুনাফা বয়ে আনতে পারেনি।১৮৮৬ সালে তৃতীয় ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধের পর বামার্র সব তেল ক্ষেত্র বৃটিশ নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে আসে।কার্গিলের জন্য তেল ব্যবসার রাস্তা সহজ হয়ে যায়।তিনি রেঙ্গুন কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে ‘বার্মা অয়েল কোম্পানি করেন।

১৮৮৮ সালে বার্মা অয়েল কোম্পানি প্রথমবারের মতো বার্মায় যন্ত্রের সাহায্যে খনন কার্য চালু করে।গভীর খনন কাজের প্রয়োজনে তারা ভারত থেকে দক্ষ খননকর্মী নিয়ে আসতো।অবশ্য তারা কয়লা খননের কাজে অভিজ্ঞ ছিল বেশী। ১৮৯১ সালের মধ্যে ৩১টি তেল উৎপাদনকারী কূপ খনন করা সম্ভব হয়েছিল।এই সময়ের পর থেকে প্রতি বছর নতুন তেল কূপের সংখ্যা বাড়তেই থাকে।বিত্তসির জন্য স্থানীয় তেলের বাজারও ছিল ঝুঁকি মুক্ত।কারণ বৃটিশ উপনিবেশিক সরকার অন্যান্য তেল কোম্পানিকে বার্মাতে ব্যবসা করার কোন ভাল সুযোগ দেয়নি। ১৮৯৬-৯৭ সময়কালটি বার্মা অয়েল কোম্পানির ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তনকারী বছর।১৮৯৬ সালের পরে ইনানইয়াং তেল ক্ষেত্রে যেসব কূপ খনন করা হয়েছিল তার প্রায় সবই ৭০০ ফুটের বেশী গভীর।১৮৯৯ সালের পর থেকে কোম্পানি নিজস্ব ট্যাংকারের মাধ্যমে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় তেল সরবরাহ করে।বিংশ শতাব্দীর আগমনের সাথে সাথে বার্মার তেল শিল্পে এক নতুন গতি সঞ্চার হয়।

১৯০৪ সালে বিওসির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডেভিড কার্গিলের মৃত্যু পর কোম্পানির ব্যবস্থাপক ফিনলের কাজের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়; কারণ নতুন চেয়ারম্যান জন কার্গিল তাঁর পিতার ন্যায় কোম্পানি পরিচালনায় তত বেশী দক্ষ ছিলেন না।যাহোক ফিনলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও বুদ্ধিমত্তার ফলে বিওসির অগ্রযাত্রা টিকে থাকে।১৯০৫ সালে বৃটিশ নৌ-বাহিনী যুদ্ধ জাহাজে তেল ব্যবহারের নিমিত্তে বিওসির সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি সাক্ষর করে। ১৯০৯ সালে বিওসির সাবসিডিয়ারী হিসেবে গঠিত হয় ইঙ্গ-পারসিয়ান অয়েল কোম্পানি। ১৯৪৫ সালে মিত্রবাহিনী কর্তৃক বার্মা পুন:উদ্ধার হলে বিওসি তার পুনঃনির্মাণ কাজ শুরু করে।১৯৬৩ সালে বিওসি তার বার্মাস্থ সম্পত্তি অপেক্ষাকৃত কম দামে বার্মা সরকারের নিকট বিক্রি করে।একইভাবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও বিওসি’র সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অধিগ্রহন করা হয়।
ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি :
ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জন ডি.রকফেলার ১৮৩৯ সালে নিউইয়র্কের এক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।১৮৭০ সালের ১০ই জানুয়ারি রকফেলার মাত্র ৩১ বৎসর বয়সে ওহাইও ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি নামে একটি তেল কোম্পানির গোড়াপত্তন করেন।১৮৮৬ সলে স্ট্যান্ডার্ড-ভ্যাকুয়াম অয়েল কোম্পানির জার্মান সহযোগী বৃটিশদের তৈরী ২৯৭৫ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি নতুন স্টীম ট্যাংকার ক্রয় করে, যার নাম ছিল এস এস গুস্কট।ট্যাংকারের ধারন ক্ষমতা বেশী হওয়ায় ব্যারেলে তেল পরিবহনের চাইতে এই পদ্ধতিতে কেরোসিন পরিবহন ব্যয় ২৫% কমে যায়।ছয় বছরের মধ্যে কোম্পানি এরকম ৮০টি ট্যাংকারের মালিক হয় এবং আটলান্টিক মহাসাগরে পরিবহন ব্যবসায় নিয়োজিত হয়।১৮৮৮ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ৭৮% কেরোসিন উৎপাদন করে বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়; অন্যদিকে সে সময় রাশিয়ার উৎপাদন ছিল মাত্র ২২%।

১৯১১ সালে আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েলকে যুক্তরাষ্ট্রে তার অবৈধ একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধ করার জন্য আদেশ দিলে ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির কার্যক্রম ৩৪টি কোম্পানিতে বিভক্ত হয়ে যায়।১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এর নাম পরিবর্তন করে. আর যুক্তরাষ্ট্রের বাহিরে অন্যান্য দেশে নাম বহাল থাকে।২০০৮ সাল পর্যন্ত ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব নিউজার্সি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন আইল্যান্ডস এবং পূয়েটরোরিকুতে নামের ব্যবহার অব্যাহত রাখে।পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এস্যো ব্রান্ড এবং মবিল ব্রান্ড এর প্রাথমিক নাম।

রকফেলার তার ব্যবসাকে এমনই বিস্তৃতি করেছিলেন যে, বিশ্বে সাত বোন হিসেবে পরিচিত সাতটি বৃহৎ তেল কোম্পানির তিনটির গোড়াপত্তন হয় তার প্রতিষ্ঠিত ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির মধ্য থেকে।এ তিনটি কোম্পানি এক্সন/এস্যো, মোবিল ও সোকল বিশ্ব বাজারে তিনকন্যা হিসেবে পরিচিত লাভ করে।তিনটি কোম্পানির মধ্যে বড় বোন ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েল যুক্তরাষ্ট্রে “এক্সন” পৃথিবীর অন্য সকল স্থানে “এ্যাসো” নামে পরিচিত।আর ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি অব নিউইয়র্ক (সোকোনী) মোবিল নামে পরিচিত হয়ে উঠে।তৃতীয় বোন স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়া সোকল পরবর্তীকালে “শেভরন” নামে বিশ্বে সুপরিচিত হয়ে উঠে।“এ্যাসো”, মোবিল এবং সোকল এই তিন বোনকে বলা হয় ষ্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ।
উপরোক্ত তিন বোন নিজেদের পৃথক স্বত্ত্বায় বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত এবং বিশ্বে সাত বোনের বিখ্যাত পরিবারের সদস্য যেমন- এক্সোন (এস্যো), শেল, বিপি, গাল্ফ, টেক্সাকো, মোবিল এবং শেভরণ।এই কোম্পানিগুলো বৃহদাকার তেল কোম্পানি যা তেল বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয় এবং রকফেলারের তিন কন্যার সংমিশ্রনে এক প্রকান্ড শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ব বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে একক শাসনের মাধ্যমে।কেউ কেউ তাদেরকে তেলের রাষ্ট্রপুঞ্জ বলে অভিহিত করে থাকে।

শেল অয়েল কোম্পানি:
গোঁড়াতে এই কোম্পানির মালিক মার্কোস স্যামুয়েল ছিলেন একজন এন্টিক (পুরনো শিল্পপণ্য) বিক্রেতা।বিশেষ করে তিনি মহিলাদের জন্য গহনার বাক্স তৈরী করে বাজারে বিক্রি করতেন এবং বাজারে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।১৮৩৩ সালে স্যামুয়েল এন্টিকের পাশাপাশি তাঁর দোকানে প্রাচ্যের আকর্ষণীয় শেল বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।শেলের পাশাপাশি তিনি খাদ্য-দ্রব্যও আমদানি করতেন।কয়েক বছরের মধ্যে স্যামুয়েল সামান্য এন্টিক বিক্রেতা থেকে একজন সফল আমদানি-রপ্তানি কারক ব্যবসায়ীতে পরিণত হন।১৮৭০ সালে মার্কুস স্যামুয়েলের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র মার্কুস স্যামুয়েল জুনিয়র এবং মার্কুস এস. সামর ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৯১ সালে দু’ভাই তাঁদের পারিবারিক ব্যবসাকে জ্বালানি তেল পরিবহন ব্যবসায় রূপান্তরিত করেন।প্রথমদিকে তাদের কোম্পানির নাম দেয়া হয় ‘দি ট্যাংক সিন্ডিকেট’। ১৮৯৭ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শেল ট্রান্সপোর্ট এন্ড ট্রেডিং কোম্পানি’।

১৯০৭ সালে মার্কুস এর সভাপতিত্বে শেল রয়েল-ডাচ পেট্রোলিয়াম কোম্পানির সাথে ঐতিহাসিক জোটে প্রবেশ করে।এতে ৪০% শেল ট্রান্সপোর্ট এবং ৬০% রয়েল ডাচের অংশীদারিত্ব থাকে। জোটে প্রবেশ করে তারা খুব দ্রুত বিশ্বব্যাপী তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়।ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তাদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য বহু মার্কেটিং কোম্পানি গড়ে উঠ।শেল ও রয়েল-ডাচ এর যৌথ প্রচেষ্টায় রাশিয়া রুমানিয়া, ভেনিজুয়েলা, মেক্সিকো এবং যুক্তরাষ্ট্রে তেল অনুসন্ধান ও উৎপাদন কার্য শুরু হয়।বস্তুত দুটি কোম্পানির মধ্যে একতা উভয় কোম্পানির ভাগ্য সুপ্রসন্ন করে তুলে।হেনরী ডিটারডিং এর ব্যবস্থাপনায় এক বছরের মধ্যেই তারা খারাপ অবস্থা কাটিয়ে লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।বাহ্যিকভাবে তারা তিনটি আলাদা কোম্পানি হিসেবে পরিচিত ছিল।যুক্তরাজ্যে শেল পেট্রোলিয়াম কোম্পানি লিমিটেড; নেদারল্যান্ডে শেল পেট্রোলিয়াম এনভি; এবং যুক্তরাষ্ট্রে শেল পেট্রোলিয়াম ইনকো।১৯০৪ সালে বৃটিশ-ভারত সরকারের সাথে শেলের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল।কারণ বৃটিশ সরকার বার্মাতে শেল ট্রান্সপোর্টকে অয়েল কনসেশন সুবিধা হতে বঞ্চিত করে এবং উপমহাদেশে শেল কেরোসিনের উপর অস্বাভাবিক করারোপ করেছিল।
চলবে…
ড. শরীফ আশরাফুজ্জামান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড