বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন: বিলাসিতা আর বেঁচে থাকার দরকষাকষি
জলবায়ু নিয়ে চলছে রাজনীতি। চলছে দরকষাকষি। স্পষ্ট দুই পক্ষ। একপক্ষ উন্নত দেশগুলো। অন্যপক্ষ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। একজনের বেঁচে থাকার প্রশ্ন। অন্যজনের বিলাসিতা। এক পক্ষের উন্নত থেকে উন্নততর হওয়া। অন্য পক্ষের টিকে থাকার লড়াই। এই লড়াই থামাতে একমত বিশ্ব। কিন্তু বাস্তবায়নে সম্মত নয় এখনই। পৃথিবী রক্ষায় সকলে একমত হলেও কাজটা শুরু করতে চাইছে না কেউই। প্রত্যেকে চাইছে অন্য কোন দেশ শুরু করুক।
মরোক্কোতে চলছে ২২তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। সম্মেলনে চলছে এই দুই পক্ষের মধ্যে দেয়া নেয়া আর মানা না মানার নানা বিষয়ে আলোচনা সমালোচনা। এই মানা না মানা আর দেয়া- নেয়ায় কথা হচ্ছে খনিজের ব্যবহার আর অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে।
একপক্ষ তার উন্নতি’র জন্য খনিজের ব্যবহার করবে ইচ্ছেমত। এতে জলবায়ু দূষণ হতেই থাকবে। আর এই দূষণের শিকার অন্যপক্ষ। দূষণের শিকার হবে। কিন্তু খনিজ ব্যবহার করতে হবে তাদের ইচ্ছেয়। এনিয়েই মুলত বাক-বিত-া।
উন্নতদেশগুলো খনিজের ব্যবহার করে জীবনমানকে পরিবর্তন করেছে। অনুন্নত দেশগুলো যখন উন্নয়নের পথে, যখন খনিজের ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগি, তখন বাধ সাধছে উন্নত দেশগুলো।
পরিস্থিতি হয়েছে সেই, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধার মত। সম্মত আছে সবদেশ। কিন্তু শুরু করতে চায় না কেউ। প্রত্যেকে বলে অন্যরা আগে করুক। আর তাই চাপটা স্বাভাবিকভাবেই অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের উপর। উন্নত দেশগুলো একাট্টা হয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বলছে, খনিজের ব্যবহার কমাও। কয়লা পোড়ানো বন্ধ কর। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াও। কয়লা পোড়ানোর কারণে কার্বন বের হচ্ছে বেশি। আর তাতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদের বললেও নিজেরা সে কাজ করছেনা।
উন্নয়নশীল দেশগুলো বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার অনেক বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়াতে আপত্তি নেই। কিন্তু এর খরচ অনেক বেশি। এই বাড়তি অর্থ কে দেবে? যদি উন্নত দেশগুলো অর্থ দেয় তবেই সম্ভব। আর এখনই কয়লার ব্যবহার কমানো সম্ভব নয়। কারণ কম দামের বিকল্প জ্বালানি নেই। তাছাড়া অর্থনৈতিক স্বাবলম্বি আর সামাজিক উন্নয়ন যথাযথ হওয়ার পরেই, উন্নত দেশগুলোর পর্যায়ে যাওয়ার পরেই বিকল্প খনিজ ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। যেখানে যত বেশি শিল্প। সেখানে ততবেশি উন্নতি। আর যত বেশি শিল্প আর উন্নতি ততবেশি দূষণ। তাই মোটা দাগে এতদিন উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলোকেই দায়ি করেছে দূষণের জন্য। কিন্তু এখন উন্নত দেশগুলো নতুনভাবে দূষণের মাত্রা নির্ণয়ের কথা বলছে। বলছে, মাথা গুনে দূষণ ঠিক করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে গেলে কার্বন কমাতে হবে। আর কার্বন কমাতে গেলে খনিজ ব্যবহারে সংযত হতে হবে। কিন্তু নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিবেচনায় কেউ এই কাজে এগিয়ে আসছে না। বিশেষ করে যারা বেশি খনিজ ব্যবহার করে তারা সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দিচ্ছে। ফলে কার্বন কমানোর উদ্যোগ নিতে পারছে না বিশ্ব রাজনৈতিক নেতারা।
জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ প্রভাব মোকাবেলায় কিছু করতে হবে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলেও কে আগে সেই উদ্যোগ নেবে তা নিয়ে চলছে বিশ্ব রাজনৈতিক কূটচাল। সম্মেলনজুড়ে কূটনৈতিক তৎপরতায় ব্যস্ত উন্নত দেশগুলো। আর অনুন্নত দেশগুলো তাদের দাবি আদায়ে মরিয়া।
আমেরিকা, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জার্মান, জাপানসহ উন্নত দেশগুলো কার্বন কমানোর উদ্যোগে মূল বাধা। এরসাথে যোগ হয়েছে চীন, ভারত আর ব্রাজিল। এই তিনদেশ উন্নয়শীল হলেও প্রচুর কয়লা ব্যবহার করে। তাই উন্নত দেশগুলো এই তিনদেশকে দ্রুত কয়লার ব্যবহার কমাতে বলছে। কিন্তু তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্তে সম্মত নয়। উন্নত ঐ সব দেশের সাথে ব্রাজিল, চীন ও ভারত কার্বন কমানোর উদ্যোগ না নিতে অনঢ়। কাগজে কলমে চুক্তি করলেও কীভাবে তা বাস্তবায়র না করে থাকা যায় সেই প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর কার্বন কমাতে সহায়তা করতে জলবায়ু তহবিল গঠন করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর অর্থে এই তহবিল। মজার বিষয় হচ্ছে, এই তহবিলের অর্থের মূল কাজ উন্নত দেশগুলোকে আরও বেশি কার্বন নির্গত হতে দেয়া। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশ খনিজ পুড়িয়ে, শিল্প চালু রেখে পরিবেশ দূষণ করবে আর উন্নয়নশীলদেশকে তা বন্ধ রেখে দূষণ সমন্বয় করতে হবে। এতে রাজি উন্নয়নশীল দেশগুলো। তবে তহবিলের অর্থ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। এই তহবিলে ৩৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে বলে দাবি করেছে উন্নত দেশগুলো। আর উন্নয়শীলদেশগুলো বলছে, দেয়া হয়েছে মাত্র পাঁচ বিলিয়ন ডলার। সামাজিক উন্নয়নে যে অর্থ দেয়া হত সেগুলোকেও জলবায়ু তহবিলের জন্য দেয়া হচ্ছে বলে বলছে উন্নতদেশগুলো।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয় ও ক্ষতি ঠিক করতে আলাদা স্বাধীন সংগঠন গঠন করার কথা ছিল। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। এটা না করতে কঠর অবস্থানে যুক্তরাস্ট্র ও কানাডা। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ও ক্ষতি বলতে কিছু নেই বলে তারা দাবি করছে। এজন্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কোন প্রশ্নই আসে না। বলছে, এটা একটি অভিযোজনের বিষয়। অভিযোজনের মাধ্যমেই একে নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে অস্ট্রেলিয়াও ক্ষয় ও ক্ষতি বলতে কিছু নেই বলে জানিয়েছে। এবিষয়ে যা কিছু তা সব অভিযোজনের মধ্যে করতে হবে। এখাতে যে অর্থের প্রয়োজন হবে তা অভিযোজন থেকেই যাবে। আলাদাভাবে কোন কিছু করার সুযোগ নেই। আলাদা সংগঠন হলে উন্নয়নশীল দেশগুলো আলাদা তহবিল দাবি করবে বলে উন্নতদেশগুলো সম্মত হচ্ছে না। অন্যদিকে জি-৭৭ ও চীন গ্রুপও (১৪০টি দেশের জোট) তাদের প্রস্তাবের বিষয়ে অনড় ।
২০২০ সালের মধ্যে আইনগত বাধ্যবাধকতা কার্যকর না হলে পুরো মানব জাতি অস্তিত্ব সংকটে পরবে। গ্রীণ হাউজ গ্যাসের ঘনত্ব ৪০০ পিপিএম ছাড়িয়ে গেছে। এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ব এক গুরুতর অবস্থায় এসে দাড়িয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে, ২০২১ সালে বৈশ্বিক উঞ্চতা চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। এ সবকিছুই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ন অগ্রাধিকার অভিযোজন। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল উপকূলীয় অঞ্চল। যা ঘূর্নীঝড় আইলার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। লবনাক্ততার কারণে বিপুল পরিমান আবাদি জমি অনাবাদি হয়ে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিনত হয়েছে।