ভয়াবহ জ্বালানি সংকটে শ্রীলঙ্কা

পাসেন্দু পিতরানা, কলম্বো:

ঘরে বিদ্যুৎ নেই। দিনে ১৮ ঘণ্টাই লোডশেডিং। বাইরে ঘুরে আসব? সে উপায়ও নেই। গাড়ির চাকা ঘোরানোর পেট্রোল নেই। পেট্রোলের জন্য মানুষ তিন দিন ধরে লাইন দিয়ে আছে। দাম বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শুধু পেট্রোল নয় শিশুদের দুধের মতো জরুরি পণ্যও আজ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এই হলো অনিন্দ্যসুন্দর শ্রীলঙ্কার বর্তমান চিত্র।

দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা, মাথাপিছু আয়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা শ্রীলঙ্কা এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে পড়ল? বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিতে বন-পাহাড়, স্বচ্ছ সৈকতের অবারিত সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীলঙ্কা। তারা হয়তো অবাক হচ্ছেন দেশটির আজকের করুণ দশা দেখে। আসলে অনেকদিন ধরে ধীরে ধীরে এই বিপর্যয়কর পরিণতির দিকে ধাবিত হয়েছে শ্রীলঙ্কা।

বিদেশ থেকে ঋণ করে কয়েকগুণ বেশি খরচে বন্দর, এক্সপ্রেসওয়ে, রাস্তা, ফ্লাইওভার ঝাঁ চকচকে করা হয়েছে। সৌন্দর্যের আড়ালে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বদলে যাবে- এমন গল্প শোনানো হয়েছিল। বাস্তবে হয়নি। ঋণের টাকায় করা এসব প্রকল্পের সুবাদে কর্মসংস্থান বাড়েনি, রাজস্বও বাড়েনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে- শত শত কোটি ডলারে সমৃদ্ধির আলো বাড়েনি। প্রকল্পগুলো এখন জগদ্দল পাথরের মতো লঙ্কানদের ওপর চেপে বসেছে। বিপরীত দিকে কর্মসংস্থান, রাজস্ব না বাড়ায় শত শত বিলিয়ন ডলারের বিপুল অঙ্কের ঋণের কিস্তি পরিশোধের উপায় নেই। আজ তার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ লঙ্কানরা।

বলা হচ্ছে, করোনার কারণে আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন খাত বন্ধ থাকায় অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে শ্রীলঙ্কার, যা ঠিক নয়। বর্তমান সরকার ও তার পূর্বসূরিদের ভুলনীতি ও কুশাসনের কারণেই আজকের এ নিদারুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার কোনো চিন্তাভাবনা না করেই শুধু হাততালি পেতে রাজস্ব ও ভ্যাট কমিয়েছিল। তাতে এখন সরকারের কোষাগার খালি। তা পূরণ করতে বেশুমার টাকা ছাপানো হয়েছে। এটিই সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হয়ে দেখা দিয়েছে। চরম মূল্যস্ম্ফীতি তৈরি হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার প্রায় শূন্য। বর্তমানে মাত্র ২৩০ কোটি ডলার রিজার্ভ আছে। বিলাসী প্রকল্পের জন্য যে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, এ বছর তার কিস্তি দিতে হবে ৮৯০ কোটি ডলার। ঋণ পরিশোধ করবে নাকি নিত্যপণ্য আমদানি করবে? তেল, দুধ, চিনি, খাবার আমদানি বন্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষের পেটে পাথর বাঁধার অবস্থা হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে ভালো কিছু হবে, শিগগির সংকট উত্তরণ হবে- তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার মানুষ খাবার কষ্টে ভুগছে।

শ্রীলঙ্কার এমন দুরবস্থা ছিল না। সরকার পরিবেশ রক্ষার কথা বলে কারও পরামর্শ না শুনে, কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না করে কৃষিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। ফলে আশঙ্কাজনক হারে খাদ্য উৎপাদন কমেছে। কৃষক জৈব সার ব্যবহার করবে, সেই বিকল্প রাখা হয়নি। সরকার বোঝোনি- বিকল্প ব্যবস্থা না করে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার ফল ভালো হয় না।

কীভাবে চলছে শ্রীলঙ্কা? গোটাবায়ে রাজপাকসে লঙ্কান প্রেসিডেন্ট। তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রী। তাদের আরও দুই ভাই ও ছেলেরা মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। দেশ পরিচালনায় তারাই সর্বেসর্বা।

শুধু বর্তমান সরকার নয়, আগের সরকারগুলোও ঋণ করে শ্রীলঙ্কার অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। রাজাপাকসে পরিবারের শাসনেও সেই ভুলনীতি উৎপাত। করোনাকে অজুহাত দিলে চলবে না। করোনা কমে আসার পর পর্যটন খুলেছে। তাতে পরিস্থিতির তো উন্নতি হচ্ছে না। দিন দিন আরও নাজুক হচ্ছে। কবে সংকট কাটবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এটি সবচেয়ে বড় সমস্যা।

সংকটের কারণ যাই হোক, শ্রীলঙ্কার মানুষ খাবার, তেলের জন্য লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ক্লান্ত। অসহায় মা-বাবা তার সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে চায়। জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, মেগাপ্রজেক্ট, বৈদেশিক ঋণ- এসব তারা বোঝেন না। জানার দরকারও নেই। এর জন্য তারা দায়ী নন। যারা দায়ী তাদের ফল ভোগ করা উচিত।

শ্রীলঙ্কার মানুষের দিন অন্ধকারে কাটছে। তেলের অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ। এই অন্ধকারে সাধারণ তাদের ভবিষ্যৎ খুঁজে পাচ্ছে না। পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হয়তো অনেক সময় লাগবে। তবে ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। এ জন্য সমস্যাকে স্বীকার করতে হবে। সমাধানের দিকে হাঁটতে হবে। মেগা প্রকল্পের চেয়ে মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে।

 

(লেখক : শ্রীলঙ্কার এনজিও সর্বদয়া শান্তি সেনার প্রজেক্ট ম্যানেজার।

দৈনিক সমকাল থেকে নেয়া)