ভারতে এলপিজি যাবে, প্রাকৃতিক গ্যাস নয়: প্রধানমন্ত্রী

pm energy bangla

ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির চুক্তি নিয়ে সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ এলপিজি রপ্তানি করবে, প্রাকৃতিক গ্যাস নয়; এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝিরও কোনো অবকাশ নেই।

বুধবার বিকালে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের সঙ্গে করা চুক্তি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা বিদেশ থেকে এলপিজি এনে প্রক্রিয়াজাত করে ভারতে রপ্তানি করব। এতে করে আমাদের ভ্যালু এড হবে। সেই গ্যাস আমরা রপ্তানি করব। এটা প্রাকৃতিক গ্যাস নয়। বরং আমাদের রপ্তনির তালিকায় নতুন একটি পণ্য যুক্ত হবে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এলপিজি প্রাকৃতিক গ্যাস নয়, এটা বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় না। বিদেশ থেকে কিনে আনা অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম শোধন করার সময় বাই প্রডাক্ট হিসেবে কিছুটা এলপিজি পাওয়া যায়। আবার গ্যাস উত্তোলনের সময় কিছুটা তেল পাওয়া যায়, যা থেকে অকটেন ও পেট্রোলের পাশাপাশি সামান্য এলপিজি পাওয়া যায়।

আমাদের দেশে আগে খুব অল্প পরিমাণ এলজিপি তৈরি হত। এখন সরকার এলপিজি আমদানি করে দেশে বোতলজাত করতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিচ্ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ২৬টি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে আমদানি করা এলপিজি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছে। ১৮টি কোম্পানি নিজস্ব প্ল্যান্ট থেকে এলপিজি প্রক্রিয়াজাত করার সঙ্গে যুক্ত আছে।

এসব তথ্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা ত্রিপুরায় যে গ্যাসটা দিচ্ছি এটা কিন্তু সেই এলপিজি, বটল গ্যাস। আমরা আমদানি করছি বাল্কে, আমরা বোতলজাত করে নিজেদের দেশে যেমন সরবরাহ করছি, সেই গ্যাসই আমরা কিছু ত্রিপুরায় দিচ্ছি। এটা হচ্ছে বাস্তবতা “

সাম্প্রতিক ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের অভিজ্ঞতা জানাতে প্রধানমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

এর মধ্যে ভারত সফরের সময় গত ৫ অক্টোবর দুই দেশের মধ্যে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, যার একটিতে ভারতের ত্রিপুরায় এলপিজি রপ্তানির কথা বলা হয়েছে।

নয়া দিল্লিতে ওই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর জল্পনা শুরু হয় যে, বাংলাদেশের গ্যাস সঙ্কটের মধ্যে ভারতে কেন রপ্তানি করা হবে। ওই চুক্তিকে ‘দেশবিরোধী চুক্তি’ আখ্যায়িত করে তা বাতিলের দাবি জানায় বিএনপি।

এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু মঙ্গলবার বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেন, “বাংলাদেশের কোনও গ্যাস ভারতে রপ্তানি হবে না। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে এলপিজি আমদানি করে তা ভারতে রপ্তানি করবে।”

আর বুধবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “দেশের স্বার্থ শেখ হাসিনা বিক্রি করে দেবে এটা কখনও হতে পারে না। বরং যে যে সমস্যাগুলো ছিল সেগুলো একে একে সমাধান করেছি।”

তিনি বলেন, “যারা এর বিরোধিতায় সোচ্চার মানে, বিএনপি, ২০০১ সালের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। আমেরিকা গ্যাস বিক্রির জন্য বলেছিল, আমি বলেছিলাম দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমরা তারপর বিক্রি করব। যে কারণে ২০০১ সালে আমরা ক্ষমতায় আসতে পারিনি। আর যারা গ্যাস বিক্রি করে দিচ্ছে বলছে, তারাই গ্যাস দেবে বলে মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, সেটা বিএনপি-জামায়াত জোট।”

দেশের এলপিজি খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বার্ষিক এলপিজির বার্ষিক চাহিদা অন্তত ১২ মিলিয়ন টন। সেখানে বর্তমানে যে অবকাঠামোগত সুবিধা রয়েছে তাতে বাংলাদেশ থেকে প্রতিমাসে অন্তত ২০ হাজার টন এলপিজি রপ্তানি সম্ভব।

ইতোমধ্যেই গত অগাস্টে বেক্সিমকো এলপিজিসহ আরও একটি প্রতিষ্ঠান ত্রিপুরায় পরীক্ষামূলকভাবে এলপিজি রপ্তানি করেছে।

ভারতের সঙ্গে করা একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার একটি শহরে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে, যা নিয়েও আপত্তি তুলেছে বিএনপি। এ বিষয়েও সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল।

উত্তর দিতে গিয়ে ফেনী নদীর উৎপত্তিস্থল ও গতিপথ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে পানিটা ভারতে দেওয়া হবে, তার পরিমাণ ‘অত্যন্ত নগণ্য’। আর তা দেওয়া হবে ত্রিপুরা রাজ্যর সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিপুরার ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ত্রিপুরা যদি কিছু চায় তাদেরকে আমাদের দিতে হবে। ১৯৭১ সালের কথা যারা মনে রাখবেন, আমাদের দেশের মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল।

“তারা আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিল, খাদ্য দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিপুরায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটা ঘাঁটি ছিল। ওখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করা হত। ত্রিপুরা আমাদের জন্য বিরাট একটা শক্তি ছিল।”
ফেনী নদীর পানি

ভারতের সঙ্গে করা একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার একটি শহরে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে, যা নিয়েও আপত্তি তুলেছে বিএনপি। এ বিষয়েও সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল।

উত্তর দিতে গিয়ে ফেনী নদীর গতিপথ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ নদীর উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি। সেখান থেকে মাটিরাঙা হয়ে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত হয়ে এগিয়েছে এ নদী। এর ৯৪ কিলোমিটার পড়েছে দুই দেশের সীমান্তে। বাংলাদেশের ভেতরে আছে শুধু ৪০ কিলোমিটার, যেটা ফেনীর সোনাগাজী হয়ে সাগরে চলে গেছে।

“সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে দুই দেশই ওই নদীর পানি ব্যবহার করে। যে অংশ থেকে পানি নেওয়া হচ্ছে, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ার কারণেই চুক্তি করতে হয়েছে। বড় অংশটাই হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে। সীমান্তবর্তী নদীতে দুই দেশেরই অধিকার থাকে “

একটি অঞ্চলের মানুষের খাবার পানির চাহিদা মেটাতেই ওই পানিটুকু দেওয়া হচ্ছে এবং এর পরিমাণ খুবই নগণ্য বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “ভারতের সাবরংয়ের মানুষের খাবার পানির খুব অভাব। তারা আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে পানি তোলে। সেখানে সামন্য পানি আমরা দেব। যে চুক্তিটা ভারতের সাথে হয়েছে সেটা তাদের খাবার পানির জন্য।

“১ দশমিক ৮২ কিউসিক পানি তারা নেবে। যে পানিটুকু তাদের দিচ্ছি সেটার পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। এতবড় একটা নদী, এই নদীর যে পরিমাণ পানি আসে তা আমরাও ব্যবহার করি, তারও ব্যবহার করে। এত চিৎকার কিসের জন্য আমি ঠিক জানি না।”

শেখ হাসিনা বলেন, “কেউ যদি পানি পান করতে চায়, আমরা যদি সেই পানিটা না দেই সেটা কেমন দেখায়? আমাদের তো আরও সীমান্তবর্তী নদী আছে, সেটা তো আমাদের চিন্তা করতে হবে।”

সাতটি আন্তঃসীমান্ত নদীতে যৌথভাবে ড্রেজিং করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এসব নদীর নাব্যতা রক্ষা এবং অন্যান্য বিষয়ে নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের চুক্তি নিয়ে বিএনপির সমালোচনার উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিএনপি নেতাদের কাছে আমার প্রশ্ন, জিয়াউর রহমান বা খালেদা জিয়া যখন ভারতে গিয়েছিল, তারা ক গঙ্গার পানি চুক্তি করতে পেরেছিল? খালেদা জিয়াকে চুক্তি সম্পর্কে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম’।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সফরে ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, তার সব জায়গায় বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে।

আসামের নাগরিক পঞ্জি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আসামের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত শান্তই। কোনো অসুবিধা হয় নাই। প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আমি যখন জানিয়েছি, তখন উনি বলেছেন, কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না। যখন অসুবিধা হয়নি, তখন উদ্বিগ্ন হওয়ারও কিছু নেই।

ভারতের আসামের নুমালিগড় রিফাইনারি থেকে পাইপ লাইনে বাংলাদেশের দিনাজপুরে ডিজেল নিয়ে আসার পাশাপাশি দিনাজপুরে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করার উদ্যোগের কথাও শেখ হাসিনা বলেন।

ভারতকে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার সুযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “পোর্ট বানিয়ে কোনো দেশ একা কেউ ব্যবহার করে না। নেপাল, ভুটান, ভারতকে আমরা বলেছি, আমাদের মোংলা আর চট্টগ্রাম পোর্ট তারা ব্যবহার করতে পারবে। তাতে আমাদের অনেক রেভিনিউ আসবে। অনেক ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা হবে।“

বিসিআইএম করিডরের (বাংলাদেশ, চায়না, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার) জন্য যোগাযোগের চুক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আঞ্চলিকভাবে এই সহযোগিতা যদি না করি, তাহলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করব কীভাবে?

“পাশাপাশি আমরা আন্তর্জাতিক রুটগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য… ভারতের কোন কোন পোর্ট আমাদের ব্যবহার করতে সুবিধা, সেটা নিয়েও কিন্তু আমরা আলোচনা করছি। একটা দেশ একা একা তো উন্নত হতে পারে না। সকলের সাথে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যের পরিধি বৃদ্ধি করা…।”

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এবং নেপাল ও ভুটান থেকে ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে বিদ্যুৎ আনার উদ্যোগের কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেন।

“এটা যদি দেশ বেচা হয়, তাহলে আমার কিছু করার নেই। দেশটা এমন না যে ধরে এনে বেঁচে দিলাম। যেটাই করে যাচ্ছি এতে কিন্তু দেশ লাভবানই হবে। কারো লোকসান হবে না।”

শেখ হাসিনা বলেন, “তারপরও সমালোচকরা সমালোচনা করবেন আমি জানি। কিন্তু আমার নিজের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে, আমি যেটা করি দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য করি, দেশের জনগণের মঙ্গলের জন্য করি, দেশের উন্নয়নের জন্য করি। সেটা আমি করে যাবই।”