মূল্যস্ফীতি কমানোর ‘পথ তৈরি’র তাগিদ বিশ্ব ব্যাংকের, ‘অপেক্ষার’ পরামর্শ অর্থমন্ত্রীর
উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর পথ খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন ঢাকা সফররত বিশ্ব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) আনা বেয়ার্দ। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, এটি রাতারাতি কমানো সম্ভব নয়।
রোববার সকালে দুই জনের এই বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর পরামর্শও উঠে এসেছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর ‘লড়াইয়ে’ বিশ্ব ব্যাংক সহযোগিতা করবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
শেরেবাংলা নগরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) মন্ত্রীর দপ্তরে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের আনা বেয়ার্দ সাংবাদিকদের বলেন, “বৈঠকে আমরা বাংলাদেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি।
“চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কিছু সংস্কার দরকার বলে আমরা মনে করছি। বিশেষ করে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতই বাংলাদেশকে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় মনোযোগী হতে হবে এবং মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমানো যায় সেই পথ তৈরি করতে হবে।”
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ এ নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। তবে সেই লক্ষ্যের চেয়ে অনেক দূরে বাংলাদেশ।
২০২০ সালের ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির সমস্যায় পড়ে। ২০২৩ সালে বছর জুড়েই মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ এর কাছাকাছি। সেটি কমিয়ে আনার অঙ্গীকার আছে ক্ষমতাসীন দলের। তবে জানুয়ারিতে তা হয়েছে ৯.৮৬ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি কমাতে বিশ্ব ব্যাংকও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে আশ্বাস বিয়ে বেয়ার্দ বলেন, “কোন কোন বিষয়ে সহযোগিতা দরকার হবে, তা আমাদের দুই পক্ষের মূল্যায়নেই নির্ধারণ করতে হবে।”
বাংলাদেশ কী কী করতে পারে, সে বিষয়ে এক প্রশ্নে সামাজিক নিরাপত্তা খাত সংস্কারের তাগিদ দেন বিশ্ব ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “যেসব মানুষ মূল্যস্ফীতিতে বেশি আক্রান্ত, তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছি আমরা।”
পরে অর্থমন্ত্রী বলেন, “উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবেলার সকল ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার সুফলও পাওয়া যাবে।”
রাতারাতি কিছু করা সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, মূল্যস্ফীতি রাতারাতি কমবে না। রমজানের পর থেকে বিশেষ করে মে জুন মাসের দিকে কমে আসবে বলে আমরা আশা করছি।”
বৈঠকে ছিলেন অর্থ সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারও। তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেন, “আগামী রমজান মাস ও ঈদুল ফিতরের পর সাধারণ মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে কমে আসবে এবং জুনের মধ্যে তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশে থাকবে।”
‘কঠিন সময় থেকে বের হবে বাংলাদেশ’
বর্তমানের সময়টাকে সারা বিশ্বের অর্থনীতির জন্যই ‘কঠিন’ বলে আখ্যা দেন বিশ্ব ব্যাংক এমডি।
তিনি বলেন, “দুই বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতি একটার পর একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন একটি সংকটময় সময় পার করছে। বিগত দুই বছর ধরে আমরা সংকটের পর সংকট মোকাবিলা করছি। এই সংকটে পুরো বিশ্ব অর্থনীতি আক্রান্ত হয়েছে।
“এই দুঃসময়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। তবে আমরা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী যে বাংলাদেশ এই কঠিন সময় থেকে বেরিয়ে আসবে।”
বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসাও করেন বেয়ার্দ। বলেন, “দারিদ্র্য থেকে ব্যাপকভাবে জনসংখ্যাকে বের করে আনতে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের রেকর্ড অত্যন্ত সফল বলে আমরা মনে করি।”
বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংকের সবচেয়ে কম সুদের তহবিল এআইডিএ তহবিলের সবচেয়ে বড় অংশীদার উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখন বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চলমান প্রায় ৫০টি প্রকল্পের বিপরীতে ১৬ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।”
অর্থমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ এখন যে চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তা নতুন নয়। বাংলাদেশ যেভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা করছে বিশ্ব ব্যাংক তার প্রশংসা করেছে।”
আলোচনায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেলের মতো মেগা প্রকল্পের কথাও উঠে এসেছে জানিয়ে মাহমুদ আলী বলেন, “এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তারা (বিশ্ব ব্যাংক) শেখ হাসিনা সরকারের প্রশংসা করেছেন।”
অর্থ সচিব বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি দল দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও উন্নতিতে সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে।
“বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি দল দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক খাতে সরকারের পদক্ষেপ ও কর্মসূচিকে ‘রাইট অন ট্র্যাক’বলে অভিহিত করেছে।”
পাইপলাইনের অর্থ কার্যকরভাবে ব্যবহার প্রসঙ্গ
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী জানান, পাইপলাইনে থাকা অর্থ নিয়েও আলোচনা হয়েছে দুই পক্ষে।
গত বছর প্রধানমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফরের সময় বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে ২২৫ কোটি ডলারের অর্থায়ন চুক্তি সই হয়েছিল। এ বছর সংস্থাটির সঙ্গে ২৬০ কোটি ডলারের অর্থায়ন চুক্তিও হয়েছে।
ইআরডি সচিব বলেন, “পাইপলাইনে থাকা অর্থকে কীভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায় এবং কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়েও আমরা কথা বলেছি। তারা আমাদের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।”
বৈঠকে বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার এবং বাংলাদেশে সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি আব্দুলায়ে সেকও উপস্থিত ছিলেন।