রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের কী ক্ষতি করবে

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ উন্নয়নের পূর্বশর্ত যা ছাড়া বর্তমান বিশ্বটাকে কল্পনা করাই কঠিন। কৃষি থেকে শুরু করে ব্যবসায় বাণিজ্য, কলকারখানার উৎপাদন, অফিস আদালতের কার্যক্রম, পরিবহন, আবাসনসহ মানব সভ্যতার প্রায় সকল অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিদ্যুৎ নির্ভর। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে বিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ। অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই ছুটে চলা বড় চ্যালেঞ্জের। আর বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়ন পিপাসু দেশের জন্য তা আরও বড় ব্যাথা।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার বিপুল জনসংখ্যার নিবিড় ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। বিশ্বব্যাংকের নিম্নমধ্যম আয়ের স্বীকৃতি পাওয়া এই দেশটি স্বাধীনতার পর থেকে বার বার নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও উন্নয়নের পথে লক্ষ্ অটুট রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশের তালিকায় নিয়ে যাবার যে মহাপরিকল্পনা করেছে তা বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমানকে ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াটে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করতে হবে।
এখন প্রশ্ন হল এই বিপুল পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন কীভাবে সম্ভব? বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৬২ দশমিক ৩৮ভাগ গ্যাসভিত্তিক। প্রাকৃতিক গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই হার বজায় থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই গ্যাসের মজুদ অনেক কমে যাবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায়ই তেলের মূল্য এতো বেশি উঠানামা করে যে তার উপর নির্ভর করে বড় আকারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা কঠিন। জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা বাংলাদেশে যতটা আছে তা দিয়ে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ অকল্পনীয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপরও বাংলাদেশ গুরুত্ত্ব দিচ্ছে। পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন তুলনামূলকভাবে ব্যায়বহুল ও উচ্চতর প্রযুক্তিসাপেক্ষ। তাছাড়া সময় সাপেক্ষ।
শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় জ্বালানির বৈচিত্র থাকা খুবই জরুরী। তাই বাংলাদেশের জন্য সহজলভ্য, ব্যয়সাশ্রয়ী এবং ব্যাপক আকারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযোগী একটি নির্ভরযোগ্য জ্বালানি হতে পারে কয়লা।
একারণেই ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি) -২০১০ অনুযায়ী ২০৩০ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ ভাগ অর্থ্যাৎ ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদন করা হবে। বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক মৈত্রি সুপার থারমাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তারই একটি অংশ।
শুধু বাংলাদেশ নয় বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে কয়লাকে বেছে নিয়েছে। মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ৪০ ভাগ, জার্মানী ৪১ ভাগ, জাপান ২৭ ভাগ, ভারত ৬৮ ভাগ, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯৩ ভাগ, অষ্ট্রেলিয়া ৭৮ ভাগ, মালয়েশিয়া ৩৩ ভাগ এবং চীন ৭৯ ভাগ বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদন করে। সেখানে বাংলাদেশ মাত্র ২ দশমিক ০৫ ভাগ বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদন করে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো এখন তাই সময়ের দাবি।
পরিবেশবান্ধব ১৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রি সুপার থারমাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থান সুন্দরবনের প্রান্তসীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। আর ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট থেকে ৬৯ কিলোমিটার। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং কারিগরি ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের গবেষণা ও মতামতের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের সকল নিয়ম ও শর্ত মেনেই প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ চলছে।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব।
যে কোনো স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগে কয়েকটি বিষয় চিন্তা করতে হয়। যেমন, সেই স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে কী পরিমান মানুষকে স্থানান্তরিত করতে হবে, স্থানান্তরিত হবার ক্ষতিপূরণ কী পরিমাণ, এলাকাটি কৃষি জমি কিনা, সেখানকার পরিবহন ব্যবস্থা, পরিবেশ, আর্থ-সামাজিক প্রভাব, এলাকার উন্নয়ন ইত্যাদি। বাগেরহাটের রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থানে স্থানান্তরিত মানুষের সংখ্যা খুবই কম। কারণ সেখানকার জমি ছিল অনুর্বর, পতিত, জলাধার এবং কৃষির অনুপযোগি । জায়গাটির অনেকাংশই ছিল সরকারি খাস জমি। ১৩২০ মেগাওয়াট এর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহন, প্রয়োজনীয় পানির উৎস ইত্যাদি বিবেচনা করে এই জায়গাটি নির্বাচন করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে অত্যাধুনিক সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। এই প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বল্প কয়লায় বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। ফ্লু-গ্যাস ডি-সালফারাইজেশন (এফজিডি) এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর ফলে নির্গত গ্যাসে সক্স (Sox) নিয়ন্ত্রিত থাকবে এবং বিশেষত সালফার ডাই অক্সাইড প্রায় সম্পূর্ণ শোষিত হবে।
একই ভাবে নাইট্রোজেন এর অক্সাইড নক্স (NOx) নির্গমণ নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য আধুনিক বার্নার ডিজাইন করা হবে। একারণে নির্গত সক্স বা নক্স এর পরিমান নিরাপদ মাত্রার অতিরিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে আমদানী করা কয়লা ব্যবহার করা হবে তা লো-এ্যাশ কন্টেন্ট এবং লো-সালফারযুক্ত। ফলে অল্প কয়লা ব্যবহারে আরও কম ছাই ও কম সালফার তৈরি হবে। যা নিয়ন্ত্রণ করা বেশি সহজ হবে। উৎপাদিত ছাই ইলেকট্রস্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর (ইপিএস) এর হপার এ রাখা হবে। এর শতভাগ ছাই ব্যবহার করা হবে। ফলে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ছাই বাতাসে মিশে পরিবেশ দূষিত হবে না।
আবৃত অবস্থায় কয়লা পরিবহন, মজুদ এবং কেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে। ফলে বাতাসে উড়ে বা পরিবহনের সময় পানিতে মিশে দূষণের কোনো সম্ভাবনা নেই। কয়লা পরিবহনের জাহাজ চলাচল নিয়েও উদ্বেগের কিছু নেই। বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য দৈনিক একটি মাত্র ছোট জাহাজ কয়লা বহন করবে। যার ধারণ ক্ষমতা ১০-১২ হাজার টন। পুরো ঢাকা থাকবে এই জাহাজ। এতে পরিবহনের সময় কয়লা ছড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। আর সপ্তাহে একটি মাত্র বড় জাহাজ হিরণ পয়েন্ট অথবা আকরাম পয়েন্টে আসবে। এই বিষয়ে পরিবেশ প্রভাব ও সামাজিক সমীক্ষা শেষ হয়েছে। সমীক্ষার ফলাফল ইতিবাচক।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনি ৯০০ ফুটের বেশি উচ্চতার হবে। ফলে চিমনি থেকে বের হওয়া বায়ু প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মাটির নিচের কোনো পানি ব্যবহার করা হবে না। অতি অল্প পানি লাগবে। যা পশুর নদী থেকে নেয়া হবে। পশুর নদীতে পানি প্রবাহের দশমিক ৫ ভাগ। এতে পানির ব্যবহার ও অপচয় অত্যন্ত কম হবে। তাপমাত্রা কমানোর জন্য অত্যাধুনিক কুলিং টাওয়ারের মাধ্যমে ক্লোজ্ড ওয়াটার রিসাইকেল সিস্টেম ব্যবহার করা হবে। অর্থাৎ একই পানি ঠাণ্ডা করে আবার ব্যবহার করা হবে। যে সামান্য পানি পশুর নদীতে ফেলে দেয়া হবে তা পরিশোধিত এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রা করে দেয়া হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অপরিশোধিত গরম পানি কোনোভাবেই পশুর নদীতে ফেলা হবেনা।
এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বের হওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রর চারপাশে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা হচ্ছে। এই উদোগের অংশ হিসেবে সেখানে দুই লাখের বেশি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নয় হাজার ৫০০ গাছ লাগানো হয়েছে। এই বনায়ন এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানী (প্রা.) লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) ইতোমধ্যেই বন বিভাগের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছে। এছাড়াও সার্বক্ষণিক পরিবেশগত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে এবং তা চলমান থাকবে।
ফলে দেখা যাচ্ছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না। ক্ষতি নয় বরং এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বনের উপর নির্ভরশীলতা কমবে। বন কেটে বসতি স্থাপন ও আবাদ, মৎস্য আহরণ এবং নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাবে। এছাড়া, কিছু লোভী ও অসাধু ব্যক্তির মুনাফা অর্জনের বলি হচ্ছে সুন্দরবন; সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে তারা প্রায়ই সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের ফলে সুন্দরবনের উপর স্থানীয় অধিবাসীদের নির্ভরশীলতা কমবে, বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য সুন্দরবনের ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের প্রবণতা কমে যাবে। যা সুন্দরবনের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে।
মৈত্রি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার ভিত্তি আরও দৃঢ় হবে। স্বল্প খরচে নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ ও শিল্প উন্নয়ন হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেচ ব্যবস্থায় নির্ভরযোগ্য এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। একইভাবে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে দেখতে গেলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। ভৌত অকাঠামোর উন্নয়ন হবে। জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বাড়বে। জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। শিক্ষাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন এবং উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযক্তির সুবিধা তৈরি হবে।
এছাড়াও সামাজিক দায়বদ্ধতায় (কর্পোরেট স্যোশাল রেসপনসিবিলিটি – সিএসআর) বিআইএফপিসিএলের জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড স্থানীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। বিআইএফপিসিএল প্রকল্প এলাকায় প্রায় দুই বছর ধরে স্থানীয় অধিবাসিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রকল্প এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম থেকে তিন পয়সা হিসাবে অর্থ দিয়ে একটি উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হবে। যা প্রকল্প এলাকার মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা হবে। এই হিসাবে তহবিলটিতে বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকা জমা হবে। এর পুরোটা জনকল্যাণ এবং বন সুরক্ষায় খরচ করা হবে। অতএব সব মিলে বলা যায়, সুন্দরবনের ক্ষতি নয়, সংরক্ষণেই দরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।

Azim
লেখক: বাংলাদশে-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানী (প্রা.) লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) এর ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) হিসেবে কর্মরত। প্রবন্ধে উল্লেখিত মতামত লেখকের নিজস্ব।

ই-মেইল: [email protected]