শিল্প, বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম যৌক্তিকভাবে সমন্বয় করতে হবে
ওয়েবিনারে বক্তারা
নিজস্ব প্রতিবেদক:
শিল্প, বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম যৌক্তিকভাবে সমন্বয় করতে হবে। তেল গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণ সর্বোচ্চগুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। নির্ভরযোগ্য সরবরাহ ও সহনীয় দাম নিশ্চিত করার জন্য জ্বালানির নিজস্ব সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের বিকল্প নেই।
‘গ্যাস সংকটকালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ ও শিল্প খাতে এর চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে এনার্জি এন্ড পাওয়ার আয়োজিত ওয়েবিনারে বক্তারা একথা বলেন।
বক্তারা বলেন, বাড়তি দামে মাত্র ৫ শতাংশ এলএনজি আমদানির কারণে মিশ্রিত গ্যাসের দাম এত পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ যৌক্তিক নয়। দেশের স্থলভাগে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বছরে কমপক্ষে ১০টি কূপ খননে বিশেষ বরাদ্ধ ও পরিকল্পনার পরামর্শ দেন। আঞ্চলিক সহাযোগিতার মাধ্যমে ভারত, নেপাল ও ভুটানে বিনিয়োগ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানি করার উদ্যোগ আরও জোরদার করতে হবে।
এনার্জি এন্ড পাওয়ার সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেনের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন। আলোচনায় অংশ নেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য প্রকৌশলী মিজানুর রহমান, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভলপমেন্টের (বিল্ড) চেয়ারপারসন আবুল কাসেম খান, এফবিসিসিআই এর জ্বালানি ও পরিসেবা স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ও এনার্জিপ্যাকের সিইও হুমায়ুন রশীদ, আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খন্দকার আবদুস সালেক সূফি এবং ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অরুণ কর্মকার।
প্রফেসর ইজাজ হোসেন বলেন, সিস্টেম লস অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এটা আসলে চুরি। এনার্জি এফিশিয়েন্সি কিছুটা বেড়েছে তবে পুরোপুরি হয়নি। এখন গ্যাস খুবই মূল্যবান। এলএনজি আমদানি করব, দাম যাই হোক না কেন বিক্রি করবÑ এই মনোভাব ভুল চিন্তা। সেক্ষেত্রে নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান না করে আমদানিতে যাওয়া বড় ভুল হয়েছে। নিজেদের কয়লা না তোলা আরেকটি ভুল। পরিবেশের ক্ষতি আমরা মোটেই করি না। বরং গ্যাসের উপর নির্ভর করে থেকেছি। আরেকটি বিষয় হলো গ্যাস ব্যবহার করে সার তৈরি করব কিনা তাও ভাবা প্রয়োজন। উত্তারিধার সূত্রে পাওয়া গ্যাস, যার দাম অনেক কমÑ তা কে ভোগ করবে তাও আমাদের ঠিক করতে হবে। শিল্প, গৃহস্থালী, সার না বিদ্যুৎ কোন খাতে ব্যবহার হবে তা ঠিক করতে হবে। যেখানে সর্বজনীন সুবিধা হয় সেখানেই গ্যাস ব্যবহার করতে হবে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্যাসের উপর আমাদের নির্ভরতা কমাতে পারিনি। যদিও গ্যাস এখন আর অফুরন্ত নয়। বর্তমানে আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তায় আমরা বিনিয়োগ করতে পারিনি। বিদ্যুৎ আমদানি বা হাইড্রো এনার্জি বাড়াতে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সৌরতে এখনও ১০ভাগে যেতে পারিনি। শুধু গ্যাসের উপর নির্ভরতার মূল্য এখন দিতে হচ্ছে। বর্তমানে ভর্তুকির পরিমাণ ৩ গুণ বেড়েছে। এটা যুক্তিসঙ্গতভাবে দেখতে হবে। এখানে ব্যালেন্স করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে শিল্পের জন্য দাম বেশি, গৃহস্থালিতে কম। এটা কম-বেশি করা যেতে পারে। ট্যারিফ র্যাশনালাইজেশন ফান্ড করা প্রয়োজন। যখন দাম কম থাকবে তখন কিছু অর্থ জমাতে হবে। যখন দাম বাড়বে তখন ভর্তুকি দিতে হবে। জ্বালানিখাতে ব্যক্তিখাতকে আরও যুক্ত করা যেতে পারে। গ্যাসের উপর চাপ কমাতে কয়লাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
মিজানুর রহমান বলেন, নিজস্ব সম্পদের স্বল্পতার কারণে জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে। এখন গ্যাসের দাম যে ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই দাম সমন্বয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ৩ বছর পর। আমি মনে করি প্রতি বছর জ্বালানির দাম সমন্বয় করা উচিত। আর গ্যাসের যে উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে খরচ তার পুরোটা ভোক্তার উপর চাপানো ঠিক হবে না। আগেও তা করা হয়নি। এবারও বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
আবুল কাশেম খান বলেন, আমরা যদি আমদানি করা জ্বালানির উপর নির্ভর করি তা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বর্তমানে দেশের যে অর্থনীতি, উন্নয়ন প্রক্রিয়া এতে তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। দেশে গ্যাস পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা। কিন্তু তা অনুসন্ধানে সঠিক উদ্যোগের অভাব আছে।
হুমায়ুন রশীদ বলেন, দেশের শিল্পখাত জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার করার জন্য বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু একধাপে গ্যাসের দাম অনেকটা বাড়ানো হলে তা শিল্প সামাল দিতে পারবে না। শিল্পে পাঁচ টাকা ভর্তুকি দিলে প্রবৃদ্ধিতে ৩৫ টাকার অবদান যোগ হবে। জ্বালানি মূল্য ও সরবরাহ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না নিলে বিদেশী ও স্থানীয় বিনিয়োগ উভয়ই বিঘ্নিত হবে।
খন্দকার আবদুস সালেক বলেন, বর্তমানে গ্যাস মিশ্রণে ৭৮ শতাংশ নিজস্ব গ্যাস আর ২২ শতাংশ এলএনজি। এলএনজির মধ্যে পাঁচ শতাংশ খোলা বাজার থেকে আমদানি করা হয়। ফলে দ্বিগুণ দাম বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কমান যেতে পারে। পেট্টোবাংলার গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারে। এমন বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
অরুণ কর্মকার বলেন, গ্যাসের চুরি এবং অদক্ষ ব্যবহার বন্ধ করার বিকল্প নেই। অন্যদিকে আমরা নিজস্ব গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ না করে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকে ঠিক কাজ করিনি।
মাসিক কাগজ রঙবেরঙ এবং ফুড অ্যান্ড ফার্মার সহায়তায় ওয়েবিনান অনুষ্ঠিত হয়।