সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যু থামছেই না

নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যু থামছেই না। প্রতিক্ষণ দেশের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছেই। যেন মৃত্যুসঙ্গী বোমা ঘরে নিয়েই বসবাস করতে হচ্ছে।  গত এক বছরের দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিমাসেই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ মারা গেছেন। জানুয়ারি মাসে শুধু রাজধানীতেই চারটি বড় বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। এতে মানুষের মৃত্যুসহ সম্পদেরও ক্ষতি হয়েছে। গত এক বছর এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এমন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে এসেছেন কমপক্ষে ৫০জন। এর মধ্যে ১০ জন মারা গেছেন।
বাসাবাড়িতে বা শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। কিন্তু কেন ঘটছে এ ধরনের ঘটনা, কীভাবে এই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং এ জন্য আসলে কারা দায়ী সে বিষয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো উদ্যোগই নেয়নি এ পর্যন্ত।
বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে এবং বিভিন্ন যানবাহনে যেসব গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে তার একটি বড় অংশ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় এগুলো বিস্ফোরিত হতে পারে। প্রতিটি সিলিন্ডারের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। দশ  থেকে ১৫ বছর।এরপর সেগুলো ধ্বংস করে ফেলতে হয়। কিন্তু দেশে গাড়িতে যেটা ১০ বছর বা ১৫ বছর আগে লাগানো হয় সেটা চলতেই থাকে। একই অবস্থা বাসাবাড়ির বোতল গ্যাসের।
সেগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। বাংলাদেশে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে যারা ব্যবসা করছেন তারাই আবার এই সিলিন্ডার পরীক্ষার সনদ দিয়ে থাকেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, সিলিন্ডারের সমস্যার কারণ থেকেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
অন্যদিকে সিলিন্ডার বিক্রিকারী কোম্পানিগুলো বলছে, সচেতনতা ও অসতর্কতার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটছে। সরকারিভাবে সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। গ্রাহকদের সচেতন করার বিষয়েও নেই কোনো কিছু। এমনকি োম্পানিগুলো যে এলপি গ্যাস সিলিন্ডারে ভরে বিক্রি করছে তারও যাচাই-বাছাই করার সুযোগ কম। এলপি গ্যাস ব্যবহারের নীতিমালা না থাকার কারণেই এই সমস্যার কোনো সমাধানও হচ্ছে না।
৫ ফেব্রুয়ারি রোববার যাত্রাবাড়ীতে বেলুনে গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে, দগ্ধ হয়েছেন আরো দু’জন। যাত্রাবাড়ীর শেখদিবটতলা গুটিবাড়ি এলাকার একটি টিনশেড বাসায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহত দু’জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
২৮ জানুয়ারি দুপুর ২টায় নবাবগঞ্জের খানহাটি গ্রামের নুর ইসলামের বাড়িতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। স্থানীয়রা জানান, দুপুরে খানহাটি গ্রামের নুর ইসলাম ও তার ভাই আজহারের পরিবারের কেউ বাড়িতে ছিলেন না। এ সময় নুর ইসলামের ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে আজহারের দুই চালার ঘরে আগুন ধরে যায়। পরে এলাকাবাসী দুই ঘণ্টা চেষ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে ঘরসহ সব আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
১৫ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগ এলাকায় গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক ব্যক্তি মারা যান। তার নাম মো. ওয়াহিদল্লাহ। মৃত ওয়াহিদুল্লার ভাগনে শহিদুল ইসলাম জানান, বিকেল ৪টার দিকে মামা গোসলের জন্য পানি গরম করতে যান রান্না ঘরে। সেখানে গ্যাসের চুলা জ্বালানো মাত্রই হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে মামা গুরুতর আহত হয়। পরে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে ১১ জানুয়ারি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর সদর ইউনিয়নের মোশাইদ গ্রামের সর্দার বাড়িতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। অগ্নিকাণ্ডে ৮টি ঘর, কয়েকটি গবাদি পশু, নগদ টাকা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের ফলে মোট দেড় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর গুলশানে একটি বহুতল ভবনের তৃতীয় তলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিন গৃহকর্মী দগ্ধ হন। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক রুবেল জানান, দগ্ধ তিন নারী গুলশানের ওই বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। আর ওই বাড়িতেই তারা থাকতেন। সকালে হঠাৎ বিকট শব্দ হলে বাড়ির আশপাশের লোকজন ছুটে যায়। পরে আহত নারীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
গত বছর সিলিন্ডার বিস্ফোরণের সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে বগুড়ায়। বগুড়ায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ডিপোতে ৩০০ সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়।
বিপিসির এলপি গ্যাস ডিপোতে ট্রাক থেকে নামানোর সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে কেউ হতাহত না হলেও অগ্নিকাণ্ডে তিন শতাধিক গ্যাস সিলিন্ডার, একটি ট্রাক সম্পূর্ণ ও দুটি ট্রাক আংশিক আগুনে পুড়েছে। আর এতে প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ওই সময় অভিযোগ উঠেছে যে বিপিসির বেশিরভাগ সিলিন্ডারই মেয়াদোত্তীর্ণ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক পরিবেশকওই সময় অভিযোগ করে বলেন, বিপিসির এই ডিপো থেকে যেসব সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে থাকে তার বেশিরভাগেরই মেয়াদোত্তীর্ণ। বিস্ফোরণের পর দেখা গেছে অনেক সিলিন্ডারেরই নিচের তলার অংশ পাতলা হয়ে গেছে। এসব সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ। বিপিসির অধীন মেঘনা ও পদ্মা কোম্পানির ৮০ শতাংশ সিলিন্ডারই ব্যবহারের অনুপযোগী। এই ঘটনার পর বিস্ফোরক অধিদফতর জানায়, বিপিসির ১১ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করে সেগুলোর মধ্য থেকে আট হাজার গ্যাস সিলিন্ডার বাতিল করা হয়েছে।
এছাড়া ১৬ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের সময় খাগড়াছড়ি আউটার স্টেডিয়ামে বেলুনে গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পাঁচজন আহত হয়। আহতদের মধ্যে বিরেন্দ্র ত্রিপুরার পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ ও পুলিশ সদস্য শাহীনে পায়ের গোড়ালির নিচের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
গত বছরের ২৪ জুন চট্টগ্রামের বেবি সুপার মার্কেটের সামনে একটি চলন্ত অটোরিকশার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে নিহত হন অটোরিকশার চালক মো. বজলু। দুর্ঘটনার পর অটোরিকশার দুই যাত্রী আবদুল আমিন
ও তার ছেলে আবদুর রহিমকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে তারা দু’জনও মারা যান।
ঢাকার দক্ষিণখানের বাসিন্দা নাজনিন আক্তার জানান, গত প্রায় তিন বছর ধরে তিনি সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন। আগে কোনো ভয় লাগতো না। এখন পত্রিকায় একের পর এক দুর্ঘটনার খবর পড়ে ভয় পাচ্ছেন। কারণ কি কারণে এসব সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটছে তাও স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে নেই কোনো নীতিমালা। একে তো পাইপলাইনের চেয়ে বেশি দামে গ্যাস কিনে ব্যবহার করছেন, অন্যদিকে এখন জীবনেরও ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। পূবাইলের মাজুখানের বাসিন্দা পারভিন আক্তার জানান, সিলিন্ডারটা কেনার সময় সব সময়ই ভয়ে থাকি। বার বার মেয়াদ দেখি। তিনি বলেন, এখন প্রায়ই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। তাই মাঝে মাঝে সিলিন্ডার বাদ দিয়ে মাটির চুলায়ও রান্না করি।
বাংলাদেশে বিস্ফোরক অধিদফতর জানায়, রান্নার কাজে ব্যবহার করা গ্যাস সিলিন্ডারের সংখ্যা বাংলাদেশ প্রায় ৫০ লাখ। বাংলাদেশের বাজারে এখন যেসব সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে তার ৮০ শতাংশ বেসরকারি কোম্পানি। বিপিসির
সিলিন্ডার ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।