সৌদি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশের বিদ্যুৎ জ্বালানিতে বিনিয়োগের আহ্বান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থে সৌদি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।
বুধবার সকালে বাদশাহ সৌদ রাজপ্রাসাদে সৌদি আরবের ব্যবসায়ীদের সংগঠন সৌদি চেম্বার ও রিয়াদ চেম্বার অব কমার্সের নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ এবং পানি প্রাপ্তির সুবিধা আছে। আছে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা। স্বল্প ঝুঁকি এবং দ্রুত প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতার সুবিধা। এ সব একত্রে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের জন্য বিনিয়োগের সর্বোচ্চ মুনাফা প্রাপ্তির সুবিধাই নিশ্চিত করেছে।
এ সময় তার সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার মাত্র তিন হাজার ২০০ মেগাওয়াট থেকে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন ২০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তার সরকার কয়লাভিত্তিক সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও নির্মাণ করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পারস্পরিক স্বার্থেই আপনাদের বাংলাদেশে ব্যবসায়, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, যাতে আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় একে অন্যের হাতে হাত রেখে চলতে পারি।
সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের আমন্ত্রণে চার দিনের সরকারি সফরে মঙ্গলবার সৌদি আরবে পৌঁছান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সৌদি উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন উদীয়মান খাত, যেমন- পুঁজিবাজার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, টেলিকমিউনিকেশন এবং তথ্যপ্রযুক্তি, পেট্রোকেমিক্যাল, ওষুধ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, আমি আপনাদের হাল্কা প্রকৌশল শিল্প, ব্লু-ইকোনমি, গবেষণা, উন্নয়ন ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, পানি ও সমুদ্র সম্পদ, অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোগত প্রকল্প এবং সেবামূলক খাত, যেমন- ব্যাংকিং এবং অর্থনীতি, লজিস্টিক এবং মানবসম্পদ খাতেও বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাই।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় থাকা এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় প্রণোদনার সুযোগ গ্রহণের মাধ্যমে অধিকহারে মুনাফা নিয়ে দেশে ফেরার বিষয়টিও উল্লেখ করেন। যার মধ্যে রয়েছে-আইন দিয়ে সুরক্ষিত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), ট্যাক্স হলিডে, যন্ত্রাংশ আমদানিতে স্বল্প শুল্ক, বিনাশুল্কে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির সুযোগ, রেমিট্যান্স অন রয়্যালটি, শতভাগ ফরেন ইক্যুইটির নিশ্চয়তা, লাভ এবং পুঁজিসহ বিনা বাধায় চলে যাওয়ার সুবিধা।
অন্যান্য সুবিধার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের রয়েছে প্রতিযোগিতামূলক বেতন-ভাতায় সহজে প্রশিক্ষণযোগ্য নিবেদিতপ্রাণ জনশক্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে স্বল্প ব্যয় এবং আমাদের বৃহৎ শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশের সুবিধা। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইউ), অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, জাপান এবং নিউজিল্যান্ডের বাজারে প্রবেশের সুবিধা।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কথা উল্লেখ করে বলেন, এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান দেশটিকে আঞ্চলিক যোগাযোগ, বিদেশি বিনিয়োগ এবং গ্লোবাল আউটসোর্সিংয়ের একটি কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
দেশে তার সরকারের ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাগুলো (ইপিজেড) শতভাগ রফতানি নির্ভর। সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগকে টেকসই করার জন্যই সরকার এ শিল্পাঞ্চলগুলো গড়ে তুলেছে।
শেখ হাসিনা এ শিল্পাঞ্চলগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তোলার জন্য দেশে প্রায় দুই ডজনেরও বেশি হাইটেক পার্ক গড়ে তোলার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তার সরকার দেশে ১০টি প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃজনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং দুই অঙ্কের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকায় যোগাযোগ, হাইটেক, পর্যটন, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে এ ধরনের আরও প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, আমরা সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দুই হাজার একর জমি বরাদ্দ করেছি, যেগুলো বিনিয়োগকারীদের নিজস্ব চাহিদা মোতাবেক তারা ব্যবহার করতে পারবেন।
বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবের মধ্যে চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবের ব্যবসায়িক সম্পর্কের শুরু সে সপ্তম শতকে, যখন আরবের ব্যবসায়ীরা প্রথমবারের মতো আমাদের বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আসেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা এখনও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগগুলোর পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারছি না।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগের পরিমাণ এখন ২৫টি প্রকল্পে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার, যার প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে-কৃষিভিত্তিক শিল্প, খাদ্য এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার, বস্ত্র এবং তৈরি পোশাক, চামড়া, পেট্রোকেমিক্যাল, প্রকৌশল ও সেবা খাত।
ক্রয় সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আমাদের দারিদ্র্যসীমা ৪১ দশমিক পাঁচ ভাগ থেকে ২১ দশমিক আট ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি এবং আমাদের অর্থনীতিও বিশ্বের ১০টি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত ১০ বছরে সাত শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছে এবং এ বছর সাত দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী বছর আট দশমিক ২৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যাশা করছি।
বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক খাতে দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ, যার রফতানির পরিমাণ গত অর্থবছরে ছিল ৩০ দশমিক ৬৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার’- যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম সবজি উৎপাদনকারী, চতুর্থ বৃহৎ চাল উৎপাদনকারী এবং তৃতীয় বৃহৎ মৎস্য উৎপাদনকারী দেশ।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প দেশের আরেকটি উল্লেখযোগ্য খাত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে ওষুধের ৯৮ ভাগ চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে। বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পেরও ক্রমবিকাশ ঘটছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মধ্যম আকারের সমুদ্রগামী বেশকিছু জাহাজ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রফতানি করেছি।