স্বাধীনতার ৫০ বছর: শূন্য থেকে মহাশূন্যে
তামান্না আক্তার:
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বা ৫০ বছরে ‘শূন্য থেকে মহাশূন্যে’ পৌঁছেছে বাংলাদেশ। তলাবিহীন ঝুঁড়ি উপাধি নিয়ে যে দেশের যাত্রা শুরু, পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা যে দেশের অর্থনীতি কখনই উঠে দাঁড়াবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন তাদের সকল ধারণাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশের পথে।
মাথা উচুঁ করে এগিয়ে চলেছে। পৃথিবীর বুকে শুধু মাথা উচুঁ করেই দাঁড়ায়নি, ঘুরিয়ে দিয়েছে অর্থনীতির নানা মেরুকরণ। নিজস্ব শক্ত অর্থনৈতিকভিত্তি গড়ে সূচনা করেছে ইতিহাস। আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। উন্নত দেশ হওয়ার পরিকল্পনায় আগাচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে শতভাগ মানুষের উন্নত জীবন।
মাথাপিছু আয় বেড়েছে। হতদরিদ্র মানুষ নেই বললেই চলে। বড় বড় কাজের জন্য সাহায্য পেতে বিদেশীদের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। অর্থনীতির শক্ত অবস্থানের কারণে, ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার কারণে, যে কেউ বাংলাদেশকে ঋণ দিতে আগ্রহী। বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। নিজের যোগ্যতায় বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় উঠেছে। সেই যোগ্যতা অর্জন করেছে, যেখানে তৈরি হয়েছে আস্থা।
বড়বাজারের, ১৮ কোটি মানুষের বাজারের এই ভূখণ্ডে ঢুকতে চায় বড় বড় বিনিয়োগকারীরা। আর তা থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশ আজ কতটা স্বাবলম্বী।
সকল কাজেই যখন নেতিবাচক ধারণা তখন সবকিছু পেছনে ফেলে বাংলাদেশ আজ মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। শুন্য থেকে মহাশূন্যে যাত্রা। পৃথিবীর বহু দেশ যা এখনও কল্পনাই করতে পারেনি। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।
গ্যাস, কয়লা, তেল, সৌর, পরমাণু সব জ্বালানির মিশ্রণ এখন বাস্তব। উন্নত দেশের চাহিদা মেটানোর পথনকশা নিয়ে এগুচ্ছে।
উন্নয়নে, নেতৃত্বের সাথে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে জ্বালানি। বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকায় শিল্পে উন্নয়ন হয়েছে।
কৃষি, শিল্প অনেক এগিয়েছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে শিল্প বলতে ছিল পাট, কাগজ আর চিনির কারখানা। এখন ইস্পাত, ওষুধ, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকসহ নানা শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। বিকাশ সর্বত্র, সবকিছুতে।
বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দশটা দেশের মধ্যে একটা। ১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৯৪ ডলার, আর ’৭৪ সালে ১৮২ ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নভেম্বর মাসের হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার।
আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ডিজিটাল রূপান্তরই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। তারমানে পুরোপুরি যন্ত্রের ব্যবহার। আর যন্ত্রের ব্যবহার মানে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ ছাড়া যন্ত্র চলবে না। তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মেরুদণ্ড বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্ন হতে হবে।
বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কার এবং রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমেই সূচনা হয়েছিল প্রথম শিল্প বিপ্লবের। কিন্তু পৃথিবী ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে কয়লা আর ইস্পাত ব্যবহার করে, সেটা দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব। আর তৃতীয় শিল্পবিপ্লব কম্পিউটার ইন্টারনেটের যুগ। এই যুগে বিদ্যুৎ হয়ে উঠল অপরিহার্য। কলকারখানা, শিল্প সবকিছুর শক্তি বিদ্যুৎ।
‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ শ্লোগানে মাইকিং করে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫০০ মেগাওয়াট থেকে ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এখন ক্যাপটিভ আর সৌরসহ বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। গ্রাহক ৪ কোটি ১৪ লাখ। সঞ্চালন লাইন ১২ হাজার ৯৮২ কিলোমিটার। বিতরণ লাইন ৬ লাখ ১৬ হাজার কিলোমিটার। বিতরণ লস কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫৬০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ৯৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ৪১ লাখ ৬ হাজার ৪৮৫ প্রি-পেইড মিটারস্থাপন করা হয়েছে। ৬০ লাখ পরিবার সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। গ্যাসের ব্যবহার দৈনিক বেড়ে হয়েছে ৩৩০ কোটি ঘনফুট। এলএনজি, এলপিজি, কয়লা আমদানি করা হচ্ছে।
৫০ বছরে অনেক উন্নতি হলেও, প্রায় শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছালেও, শতভাগ উন্নত মান এখনও নিশ্চিত হয়নি। জ্বালানি ব্যবহারে এখনও বৈষম্য আছে গ্রাম আর শহরে। এখন সেগুলোতে নজর দিতে হবে। সকলকে সাশ্রয়ীমূল্যে সরবরাহ করে যথাযথ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর উন্নত বাংলাদেশে, ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশে তাইই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
দারিদ্রকে জয় করে ক্রয় ক্ষমতা বাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক পরিবর্তনে চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে। খাওয়া পরার চাহিদা এখন আর নেই, যা আগে ছিল একমাত্র চাহিদা।
উন্নত বাংলাদেশের যে স্বপ্ন, মানুষের পরিবর্তিত চাহিদা পূরণের যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়ন করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আগামীর চ্যালেঞ্জ। আর এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদেও বিকল্প নেই। বৈষম্য দুর করে, কর্মসংস্থান তৈরি করে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দুর করে প্রান্তিক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা আগামীর চ্যালেঞ্জ।
আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়াতে হবে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। শুধু নিজে বাজার না হয়ে, অন্যের বাজারেও নিজেকে নিয়ে যেতে হবে। পণ্য রপ্তানি বাড়াতে হবে। আর সেই যোগ্যতা বাড়ানো হবে আগামীর বড় চ্যালেঞ্জ।
করোনার সময় অর্থনীতির নানা উত্থান-পতনের মধ্যে জ্বালানি খাতও ছিল বেসামাল। তবে তা ছিল স্বস্থির। সেহেতু আমাদের জ্বালানির বড় অংশই আমদানি নির্ভর। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম থাকায় সেই সুবিধা ভোগ করেছে বাংলাদেশ। কিছু দিন আবার বাড়তি দামের চাপ ছিল। কিন্তু সে চাপ সামলে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে, আশা।