২০২৩ সালের পরে জাতীয় গ্রিডে উল্লেখযোগ্য পরিমান দেশের গ্যাস যোগ হবে: আনিছুর রহমান

আনিছুর রহমান

জ্বালানি অর্থনীতির অন্যতম মূল শক্তি। আর প্রাথমিক জ্বালানি সংকটে বাংলাদেশ। এনার্জি বাংলা’র সাথে সংকট মেটানো, বর্তমান অবস্থাসহ নানা উদ্যোগের কথা বলেছেন জ্বালানি বিভাগের জেষ্ঠ্য সচিব আনিছুর রহমান। এখানে তুলে ধরা হলো তার অংশ বিশেষ।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রফিকুল বাসার

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো কতটা যৌক্তিক হয়েছে বলে মনে করেন?
আনিছুর রহমান: বিপিসি কিছুদিন আগে লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। আরও আগে এটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। এখন শুধু লাভজনকই হয়নি, বড় বড় চার-পাঁচটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে নিজেদের অর্থায়নে। এখন লোকসান দিয়ে চলতে থাকলে সেই প্রকল্পগুলোতেও ধাক্কা খাবে। ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এই প্রকল্পগুলো কোনটা ৭০ ভাগ, কোনটা ৮০ ভাগ কোনটা ৫০ ভাগে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পগুলো শেষ করা দরকার। না হলে তার সুফল পাওয়া যাবে না।
গত দুইবছরে যেহেতু কোভিড ছিল, টিকাসহ অন্যান্য খাতে সরকার বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, সেজন্য জ্বালানির জন্য আলাদা চাপটা যেন কম পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। এজন্য গতবছরও জ্বালানির জন্য কম ভর্তুকি চাওয়া হয়েছিল। অবশ্য গতবছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের দাম কম ছিল। সে জন্যও ভর্তুকি কম লেগেছিল। এখনও স্বাস্থ্যখাতে খরচ অনেক। তাই আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করা হয়েছে।
জ্বালানি তেলের দাম তো আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় স্থানীয় বাজারে এতদিন বেশি ছিল। বিপিসি লাভ করছিল।
আনিছুর রহমান: গত জানুয়ারি থেকে দাম ঊর্ধ্বমুখী। সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল। এখন আবার একটু নিম্নমুখি। তবে কতটা দাম কমবে তা দেখার বিষয় আছে। জ্বালানি তেল আমদানি করে জুন-জুলাই মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ভাল অবস্থায় ছিল। প্রতিব্যারেল যদি ৬৯ বা ৭০ ডলার করে কেনা হয় তাহলে বিপিসি লোকসান শুরু করে। কিন্তু দাম ৮৫ ডলার বা তার চেয়ে বেশি ছিল। ফলে তখন লোকসান শুরু হয়।
তেলের দাম কয়েকদিন আগের চেয়ে একটু কমেছে। কিন্তু তবুও এখনও দাম বেশি। এতে চাপ তো অবশ্যই আছে। তেলের দাম বাড়লে ভর্তুকিও বাড়বে। জ্বালানিতে ভর্তুকি হিসেবে গত অর্থবছর ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পেয়েছিলাম। যদিও ভর্তুকি লেগেছিল ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বর্তমান সরকার জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল গঠন করেছে, সেই তহবিলের সঞ্চিত অর্থ দিয়েই ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। মূলত এই তহবিলের অর্থে এলএনজি আমদানির টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। তার থেকেও বেশি প্রয়োজন হলে অর্থ বিভাগ থেকে নেয়া হয়।
সংকটের কারণে শিল্পকারখানা ঠিকভাবে চলছেনা। কিছুদিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে ব্যবসায়ীরা গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলেন। এজন্য দ্রুত উচ্চমূল্যে খোলাবাজার থেকে এলএনজি আনা হয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি এখন কেমন?
আনিছুর রহমান: অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিঘ্ন ঘটুক সেটা আমরা চাইনা। শিল্প হোক, কৃষি হোক কিংবা বিদ্যুৎ, কোনোটাতেই না। বিদ্যুৎতেও আমরা চাহিদা অনুযায়ী দিতে পারছি। মাঝে কিছু দিন সরবরাহ কম ছিল। অতিরিক্ত দামের কারণে খোলাবাজার থেকে আমদানি কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমাদের যেহেতু সকল প্রকার উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে, রপ্তানিও বাড়াতে হবে, সেজন্য উচ্চমূল্যে গ্যাস আমদানি করা হয়েছে। তবে সব মিলিয়ে সমস্যা হবে না।
সারের একমাত্র কাঁচামাল গ্যাস। সারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল। প্রতি মেট্রিকটন ৭০০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত বছর এই সময়ছিল ২৬১ ডলার। প্রায়তিন গুণ বেড়েছে। এটা কারও জন্য সহনীয় নয়। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা ভাল আছি।
আমাদের শিল্প-কারখানা কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে যতক্ষণ চলত তার চেয়ে বেশি চলছে। যার ১৬ ঘণ্টা চালানোর কথা ছিল, তিনি এখন ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা চালাচ্ছেন। যিনি ২০ ঘণ্টা চালানোর কথা, তিনি ২৪ ঘণ্টা চালাচ্ছেন। আর যিনি ২৪ ঘণ্টা চালানোর কথা তিনি ২৪ ঘণ্টাই চালাচ্ছেন। অনুমদিত লোড থেকে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করছেন। আমরা সেটাও মেনে নিয়েছি। কারণ গত তিন মাসে ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, ১১ শতাংশ রফতানি বেড়েছে। রপ্তানি যেহেতু বাড়ছে সে জন্য শিল্পে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখছি অনেক মূল্যে গ্যাস এনে। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রয়োজনীয় গ্যাস আনা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতি তো চলতেই থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়বে। সংকট হবে। আমরা কী এভাবেই অনিশ্চয়তা নিয়েই চলব? নাÑএর স্থায়ী কোন সমাধান আছে?
আনিছুর রহমান: চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কাঙ্খিত মাত্রায় বাড়াতে পারিনি। পুরোপুরি পারিনি তাও না। করোনাকালীন প্রায় ৯ কোটি ঘনফুট দেশীয় গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে। তবে নতুন কূপ খনন বা নতুন গ্যাস আবিষ্কারে নজর এখনও পর্যন্ত দিতে পারিনি। ওয়ার্কওভারগুলো দিয়ে চলছে। এগুলো আমাদের আরও কয়েকবছর আগে করা উচিত ছিল। এক্সপ্লোরেশন এবং ওয়ার্ক ওভারের ওপর যদি আরও একটু নজর দিতাম, তাহলে উৎপাদন আরও বাড়তো। তাতে এলএনজি আমদানি এতটা লাগতো না। আমদানি কমাতে পারতাম। এখন ৫০ কোটি থেকে ৬০ কোটি ঘনফুটের পার্থক্য থাকে, যেটা পূরণের জন্য এলএনজি আনা হচ্ছে।
আমরা যেগুলো হাতে নিয়েছি সেগুলো পর্যায়ক্রমে দুই আড়াই বছরে চলে আসবে। আশাকরি ২/৩ বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নিজেদের গ্যাস সঞ্চালন লাইনে যোগ করতে পারব।
কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?
আনিছুর রহমান: সমুদ্রে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। সমুদ্রে আরও দুইটা হবে। ভোলাতে খনন শুরু হবে জানুয়ারিতে। ভোলায় গ্যাস আগেও পেয়েছি। সেখানে সম্ভাবনা বেশি। শরীয়তপুরে নতুন একটা কূপ খনন হচ্ছে জানুয়ারি থেকে। ওখানে সম্ভাবনা আছে। এসবে বাপেক্সকে কাজে লাগানো হয়েছে। যেখানে বাপেক্সের সক্ষমতা নেই সেখানে বিদেশিদের সহায়তা নেয়া হবে। বাপেক্সের ব্যানারে হবে। কূপ খনন করতে বাপেক্সের ক্ষমতা আছে চার হাজার থেকে চার হাজার ২০০ মিটার পর্যন্ত। আমরা পাঁচটা গভীর কূপ খননের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই পাঁচটা কূপ সাত হাজার মিটার পর্যন্ত গভীর হবে। আমাদের অত গভীরে যাওয়ার রিগ নেই। সেক্ষেত্রে হয়তো রিগ ভাড়া নেব। রিগ ভাড়া নিয়ে যে পাঁচটা গভীর কূপ খনন করা হবে সেখানে সম্ভাবনা আছে। দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক জরিপ হয়েছে, সে অনুযায়ী বোঝা যাচ্ছে এর সম্ভাবনা অনেক। ৪ হাজার মিটারে যখন পাচ্ছি ৭ হাজার মিটারে আরও পাওয়া যাবে।
যেখানে পর্যাপ্ত তথ্য নেই সেখানে দ্বিমাত্রিক ত্রিমাত্রিক জরিপ করা হচ্ছে। আরও তথ্য নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সমস্ত বাংলাদেশে এই জরিপ হয়ে যাচ্ছে। জরিপ হয়ে গেলে একটা সুবিধা যে নিজেদের সুবিধামতো সময়ে নির্দিষ্ট স্থান ঠিক করে কূপ খনন করা যাবে। সম্ভাবনাময় জায়গায় আগে করছি। এগুলো ২০২৩ এর মধ্যে সব শেষ হবে। তারপর অর্থাৎ ২০২৩ সালের পরে জাতীয় গ্রিডে উল্লেখযোগ্য দেশের গ্যাস যোগ হবে বলে আশা করি। তবে এগুলো আরও আগেই নজর দিলে এখন আসতো।
সমুদ্রে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
নতুন বিডিংএ গ্যাসের দাম কী আরও বাড়বে?
আনিছুর রহমান: আরও আকর্ষণীয় করা হয়েছে। যাতে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যায়। ১০ বছর আগের দামে তো পাবো না। কারণ সবকিছুর দাম বেড়েছে। ছয় মাস আগে পর্যালোচনা করেছি। যাতে আকর্ষণীয় হয়। এখন যেহেতু তেল-গ্যাসের দাম বাড়তি সেজন্যই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাবে আশা করি।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আনিছুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ইনসার্ট
আমাদের শিল্প-কারখানা কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে যতক্ষণ চলত তার চেয়ে বেশি চলছে। যার ১৬ ঘণ্টা চালানোর কথা ছিল, তিনি এখন ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা চালাচ্ছেন। যিনি ২০ ঘণ্টা চালানোর কথা, তিনি ২৪ ঘণ্টা চালাচ্ছেন। আর যিনি ২৪ ঘণ্টা চালানোর কথা তিনি ২৪ ঘণ্টাই চালাচ্ছেন। অনুমদিত লোড থেকে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করছেন। আমরা সেটাও মেনে নিয়েছি। কারণ গত তিন মাসে ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, ১১ শতাংশ রফতানি বেড়েছে। রপ্তানি যেহেতু বাড়ছে সে জন্য শিল্পে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখছি অনেক মূল্যে গ্যাস এনে। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রয়োজনীয় গ্যাস আনা হয়েছে।

২০২৩ সালের পরে জাতীয় গ্রিডে উল্লেখযোগ্য দেশের গ্যাস যোগ হবে বলে আশা করি। তবে এগুলো আরও আগেই নজর দিলে এখন আসতো।