ঢাকা-গ্লাসগো ঘোষণা গৃহীত হওয়া জলবায়ুু কূটনীতিতে বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকা প্রমাণ করে : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বাসস :

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বলেছেন, কপ২৬ সম্মেলনে ঢাকা-গ্লাসগো ঘোষণা গৃহীত হওয়া বাংলাদেশের জলবায়ুু কূটনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা পালনের ফলাফল। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের নেতৃত্বে সবচেয়ে বেশি ৪৮টি জলবায়ুু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের দ্বারা ঢাকা-গ্লাসগো ঘোষণা গৃহীত হওয়া জলবায়ু কূটনীতিতে আমাদের দেশের অগ্রণী ভূমিকার ফল।’ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে তাঁর ১৪ দিনের সরকারি সফর সম্পর্কে গণমাধ্যমকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, কপ২৬-এর প্রধান কৃতিত্ব হল বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা প্যারিস চুক্তি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-র সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দসহ জলবায়ু তহবিল প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে সম্মত হয়েছেন।
বাংলাদেশসহ ১৪১টি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ধরনের অরণ্য নিধন রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে তাঁকে কপ২৬-এর পাঁচজন চুক্তি প্রস্তুুতকারীর একজন হিসাবে নির্বাচিত করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একে আমি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন আমাদের নৈতিক পররাষ্ট্র নীতির প্রতি বিশ্ববাসীর আস্থা হিসেবে বিবেচনা করে সম্মানিত বোধ করি।’ তাঁর সফরের বিস্তারিত অবহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে তাঁর দুই সপ্তাহের সফর এবং স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের কপ২৬ শেষে গত ১৪ নভেম্বর সকালে তিনি দেশে ফিরেছেন।
তিনি জানান, এবারের সফরের বিভিন্ন পর্যায়ে সিভিএফ-এর থিমেটিক অ্যাম্বাসেডর মিজ সায়মা ওয়াজেদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রী, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। এছাড়া, ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদলও তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কপ-২৬ সম্মেলনের মূল অংশ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের শীর্ষ সম্মেলন এবং সাইড ইভেন্ট মিলিয়ে দুই দিনে তিনি ৬টি বহুপাক্ষিক সভা ও ৫টি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেন।
তিনি বলেন, কোভিড-পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থায় ৪৮টি দেশের সংগঠন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম-সিভিএফ-এর বর্তমান সভাপতি হিসেবে কপ-২৬ শীর্ষ সম্মেলনে তাঁর অংশগ্রহণ বাংলাদেশ এবং সিভিএফ সদস্য দেশগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সম্মেলনের প্রথম দিন ১ নভেম্বর তিনি সিভিএফ-এর চেয়ার হিসেবে ‘বাংলাদেশ ও কমনওয়েলথের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সিভিএফ-কমনওয়েলথ হাই-লেভেল প্যানেল ডিসকার্সন’এ তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করে কমনওয়েলথ ও সিভিএফ-এর মধ্যে কার্যকর অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে পরামর্শ প্রদান করেন। ঐদিন দুপুরে তিনি কপ-২৬-এর মূল অনুষ্ঠান ‘বিশ্ব নেতৃবৃন্দের শীর্ষ সম্মেলন’ এ বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও দাবি-দাওয়া তুলে ধরে তিনি বক্তব্য প্রদান করেন। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের দায় মাত্র ০.৪৭ শতাংশেরও কম হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি বলে তিনি তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন।
এছাড়া, তিনি সম্প্রতি ইউএনএফসিসিসি’র কাছে হালনাগাদকৃত ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) প্রদান, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্লান এন্ড বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ডসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন উদ্যোগের বিষয় অবহিত করেন। পাশাপাশি, সিভিএফ-এর সভাপতি হিসেবে তিনি ক্লাইমেট ইমারজেন্সি প্যাক্ট গঠনের প্রয়াসের কথা বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরেন। বিশ্ব নেতৃত্বকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা প্রস্তান উত্থাপনের কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রস্তাবগুলো হচ্ছে: প্রধান প্রধান কার্বন নির্গমনকারী দেশসমূহকে উচ্চাভিলাষী এসডিসি প্রণয়ন, উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অভিযোজন ও প্রশমনের জন্য ৫০:৫০ অনুপাতে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুত অর্থায়ন নিশ্চিত করা, পরিবেশবান্ধব উন্নত প্রযুক্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, ক্ষয় ক্ষতিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে একযোগে কাজ করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলা।

শীর্ষ সম্মেলনের পরে তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের আমন্ত্রণে ‘একশন এন্ড সোলিডারিটি- দি ক্রিটিক্যাল ডিকেড’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বৈঠকটি প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘির যৌথ সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৩০টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে বৈঠকে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ এবং প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে চলমান কপ২৬-এ কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন তার ওপর আলোকপাত করেন।
বিকেলে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ার বিল গেটস প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বিল গেটসকে বাংলাদেশের স্থানীয় অভিযোজন মডেলগুলোকে গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য দেশসমূহে কাজে লাগানোর আহ্বান জানান।
কপ-২৬ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ২ নভেম্বর সকালে সম্মেলনের সভাপতি অলোক শর্মার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। অলোক শর্মা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
এরপর তিনি স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজন-এর ইউএন উইমেনের সহযোগিতায় আয়োজিত ‘হাই লেভেল প্যানেল অন উইমেন এন্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এ নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন, বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী মিয়া আমোর মোটলি’র সঙ্গে অংশগ্রহণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলায় নারীদের নিয়ে আরও অংশগ্রহণমূলক সমাধানের উপর জোর দেন। পরে স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজন-এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগী পদক্ষপের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এরপর তিনি যুক্তরাজ্যের যুবরাজ প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিকেলে তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে বৈঠক করের। আলোচনাকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিধি ও গভীরতা আরও বৃদ্ধি পাবে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জলবায়ু ইস্যু ছাড়াও বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ভ্যাক্সিন কূটনীতি, রোহিঙ্গা সঙ্কট এবং অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের আলোচনায় উঠে আসে।
এরপর শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ‘সিভিএফ কোপ২৬ লিডার্স ডায়ালগ শীর্ষক ডায়ালগে সিভিএফ-এর সদস্যভুক্ত দেশসমূহের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, মন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি, কপ-২৬-এর সভাপতি ব্রিটিশ এমপি অলোক শর্মা, সিভিএফ-এর ভালনারেবিলিটি বিষয়ক থিমেটিক অ্যাম্বাসেডর সায়মা ওয়াজেদসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে জলবায়ু অভিযোজনে প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড়ের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
জন কেরি জাপান এবং অন্যান্য উন্নত দেশকে সঙ্গে নিয়ে ২০২২ সাল থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদানের একটি রূপরেখা তৈরির অঙ্গীকার করেন। অলোক শর্মা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো যে ইতোমধ্যেই চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার মুখোমুখি হচ্ছে সে বিষয়টি তুলে ধরেন। সম্মেলনে ঢাকা-গ্লাসগো ঘোষণা গৃহীত হয়।
সবশেষে, প্রধানমন্ত্রী স্কটিশ পার্লামেন্টে ‘এ বাংলাদেশ ভিশন ফর গ্লোবাল ক্লইমেট প্রসপারিটি’ বিষয়ে কিনোট বক্তব্য দেন। তিনি সম্মেলন স্থলে স্থাপিত বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নও পরিদর্শন করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, গ্লাসগো থেকে লন্ডনে পৌঁছে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য রশনারা আলী, এমপি ও লর্ড জিতেশ গাধিয়ার আমন্ত্রণে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ ছাড়াও বৃটিশ বাংলাদেশী কমিউনিটির আমন্ত্রিত সদস্যদের উপস্থিতিতে এ অনুষ্ঠানে তিনি ‘বাংলাদেশ এট ৫০: এ রেজিলেন্ট ডেল্টা’ শীর্ষক একটি কিনোট বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ সিকুরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
লন্ডনের প্রকাশনা সংস্থা টেইলর এন্ড ফ্রান্সিস কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অফ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দ্য নেশন অফ বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এবং ‘মুজিব: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন’ বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়াও, তিনি ‘বঙ্গবন্ধু: এ সেন্টেনারি কালেকশন’ শীর্ষক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর উদ্বোধন এবং লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের চ্যান্সারি ভবনের সম্প্রসারিত অংশ ও এতে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু লাউঞ্জের উদ্বোধন করেন।
তিনি ৯ নভেম্বর লন্ডন থেকে প্যারিস পৌঁছালে প্যারিসের শার্ল দ্য গল বিমানবন্দরে তাঁকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ফরাসি রিপাবলিকান গার্ডের একটি চৌকশ সেনাদল স্ট্যাটিক গার্ড অফ অনার প্রদান করে। বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট মাখোঁর সরকারি বাসভবন এলিজি প্রাসাদে যান। এলিজি প্রাসাদে তিনি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন, দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কেও সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ নানা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে নিয়মিত কূটনৈতিক সংলাপ শুরু করার জন্য প্রেসিডেন্ট মাখোঁকে প্রস্তাব করলে তিনি (মাঁেখা) তা সাদরে গ্রহণ করেন। প্রেিিসডেন্ট মাখোঁ প্রতিরক্ষা ও অর্থনীতিসহ অন্যান্য খাতে দুই দেশের কার্যক্রম বাড়ানোর ব্যাপারে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একযোগে কাজ করার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। একই দিনে ফরাসি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অফ অনার প্রদান করা হয়। পরে ফরাসি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন মাতিনিও-তে তাঁর সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করি। শেখ হাসিনা বলেন, প্যারিস সফরকালে ফ্রান্সের ন্যাশনাল এসেম্বলির সভাপতি রিচার্ড ফেরোঁর সঙ্গে তিনি বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে ফ্রান্সের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। পওে তিনি ফ্রান্সের আইনসভা সেনেট পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আমাদের সরকারের ভূমিকা ও আমার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে সিনেট অধিবেশনের সভাপতি একটি মানপত্র পাঠ করেন। সফরের দ্বিতীয় দিনে এয়ারবাসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ডাসল্ট এভিয়েশনের সভাপতি, এবং বহুজাতিক কোম্পানি থ্যালেস-এর সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় বাংলাদেশের জন্য এয়ারবাস থেকে কার্গো বিমান ক্রয় ও অ্যারোনটিক্যাল প্রযুক্তি বিনিময়ের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়াও, লালমনিরহাটে এভিয়েশন ও অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ডাসল্ট এভিয়েশনের এভিয়েশন প্রযুক্তি কাজে লাগানোর প্রস্তাব এবং থ্যালেস-এর সহায়তায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ই-ভিসা চালুর বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়।
ফ্রান্সের ব্যবসায়ীদের অন্যতম সংগঠন মুভমেন্ট অব দ্য এন্টারপ্রাইজ অব ফ্রান্স (এম.ই.ডি.ই.এফ)-এর একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন এবং তাঁদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান জানান।
তিনি ১১ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট মাখোঁর আমন্ত্রণে প্যারিস পিস ফোরামের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগদান করে প্রদত্ত বক্তব্যে ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা তুলে ধরেন।
তিনি সকলের জন্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করাসহ সকল ধরনের বৈষম্য দূর করতে এবং বিভিন্ন দেশে চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ করার আহ্বান জানান এবং মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তিনি পরদিন ১২ নভেম্বর প্যারিস পিস ফোরামের একটি প্যানেল আলোচনা-সভায় অংশগ্রহণ করে দক্ষিণ-দক্ষিণ ও ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। শেখ হাসিনা বলেন, উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তিগত সমাধানসহ সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ২০১৯ সালে আমরা যে ‘সাউথ-সাউথ নলেজ অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার’ স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তা বাস্তবায়নে জাতিসংঘ, জি-২০ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থাকে বিনিয়োগের অনুরোধ জানাই।
প্রধানমন্ত্রী ১১ নভেম্বর ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্র ও ১১ সহযোগী সদস্যবিশিষ্ট জাতিসঙ্গের অঙ্গ-সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিকভাবে প্রবর্তিত ‘সৃজনশীল অর্থনীতিতে ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরষ্কার’ প্রদান করেন। উগান্ডার বেসরকারি সংস্থা ‘মোটিভ ক্রিয়েশন্স লিমিটেড’- এই পুরস্কার অর্জন করেছে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি মুজিববর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে বিশ্ব মানবতা ও শান্তিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের প্রতি এই পুরস্কার প্রবর্তন সবচেয়ে উপযুক্ত সম্মান।’ তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার ও একটি ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে মঞ্চে আমার সঙ্গে আমার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং ইউনেস্কোর মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, ফ্রান্সে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোতে স্থায়ী ডেলিগেটবৃন্দসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীগণ উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ১১ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৪১তম সাধারণ অধিবেশনে প্রথমবারের মতো তিনি অংশগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে শিক্ষাকে মৌলিক মানবাধিকার ও মানব সমাজের উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত নানা যুগান্তকারী উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। ১২ সেপ্টেম্বর তিনি ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে কোভিড ১৯-এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা খাতকে রক্ষা করার লক্ষ্যে ডিজিটাল সরঞ্জাম ও পরিষেবা, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস, ডিজিটাল বিষয়বস্তু এবং শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অধিকতর বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সফরকালে ইউনেস্কোর বর্তমান মহাপরিচালক মিজ্ আদ্রে আজুলে এবং সাবেক মহাপরিচালক মিজ্ ইরিনা বোকোভা’র সঙ্গেও তাঁর পৃথক পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তিনি বলেন, প্যারিস সফরকালে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিনিময়ের বিষয়ে সম্মত হয়েছি। পাশাপাশি, কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় ২০০ মিলিয়ন ইউরো সহায়তা, টেকসই পানি সঞ্চালন ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রকল্পে ১৩০ মিলিয়ন ইউরো সহায়তার এবং বিমান চলাচল খাতে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ প্রদান সংক্রান্ত পৃথক পৃথক তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।
কাভ্যাক্স-এর আওতায় ফ্রান্স বাংলাদেশকে ২০ লাখ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এছাড়াও, ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ফ্রান্সের ব্যবসায়ীদের সংগঠন মুভমেন্ট অব দ্য এন্টারপ্রাইজ অব ফ্রান্সের (এমইডিইএফ)-এর সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সফরকালে তিনি প্রবাসী ভাইবোনদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন।