দুর্দশা বাড়বে: বিনীত অনুরোধ পুনর্বিবেচনার
ম. তামিম:
এখন জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানো অপ্রত্যাশিত এবং অযৌক্তিক।
আন্তর্জাতিক বাজারের সর্বোচ্চ মূল্য ইতিমধ্যে আমরা পার করে এসেছি। সেই মূল্যে আমরা তেল কিনেছিও। যার প্রেক্ষিতে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এই মুর্হূতে বাজারে দাম কমতির দিকে। এবং সামনে যে প্রাক্কলন করা হচ্ছে সেখানেও বলা হচ্ছে, বছরের শেষের দিকে জ্বালানি তেলের দাম কমবে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে চাহিদা কমে গেছে। সাথে সরবরাহ বৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে তেলের মজুদ আর সরবরাহ বেড়েছে। আমেরিকা বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ তেল ব্যবহার করে। তাদের মজুদ বেড়েছে। আমেরিকায় যেটা প্রতি গ্যালন পাঁচ ডলার ছিল সেটা এখন তিন ডলারে নেমেছে। খুব দ্রুতই কমেছে। এই প্রেক্ষিতে আমাদের ধারণা সামনে মূল্য আরও কমবে। যেহেতু সামনে কমবে সেই সময় এখন হঠাৎ করে সর্বোচ্চ দামের সাথে সমন্বয় করাটা একেবারেই উচিৎ হয়নি বলে আমি মনে করি।
আমার বিনীত অনুরোধ থাকবে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার। কারণ এর যে অর্থনৈতিক প্রভাব তা অনেক।
গতবার দেখেছি, লিটারে ১৫ টাকা ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে, যেটা ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি ছিল; গাড়ির ভাড়া বাড়ানোর কথা ছিল ১০ শতাংশ। কারণ ভাড়া তো শুধু জ্বালানির উপর নির্ভর নয়। সেখানে বাসে আর লঞ্চে ভাড়া বাড়ানো হল ২৮ শতাংশ। এইবার যে ৪০ শতাংশ দাম বৃদ্ধি হল ডিজেলের। তাতে আসলে বাসে ১৬ শতাংশ দাম বাড়ার কথা। কিন্তু তা কখনও হয় না। বাস মালিকদের কাছে আমরা জিম্মি হয়ে আছি। ইতিপূর্বে কোন সরকারই বাস মালিকদের সাথে এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। মালিকদের চাহিদা মতই দাম নির্ধারণ হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে অসামঞ্জপূর্ণভাবে বাড়ে। যেটা ১০ ভাগ বাড়ার কথা সেটা ২৮ ভাগ বেড়ে গেছে। একই সাথে এক কেজি আলুর পরিবহন মূল্য যদি কেজিতে এক টাকা হয়। নতুন পরিবহন মূল্যের সাথে সেটা এক টাকা ১০ পয়সা হওয়া উচিৎ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেটা এক টাকা ৪০ পয়সা করে দিচ্ছে। এগুলোই আমাদের সমস্যা।
মূল্যস্ফীতির পরিমান কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা যেহেতু আমি অর্থনীতিবিদ না তাই বলা মুশকিল। তবে সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলতে পারি, বিশ্বের খাদ্য পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে। যুদ্ধের কারণে বিশ্বে যে খাদ্য ঘাটতি হচ্ছে তার জন্য কিন্তু একটা বৈশ্বিক প্রভাব আছে আমাদের মূল্যস্ফীতিতে। তার উপর এই দাম বৃদ্ধি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমিয়ে দেবে এটাতে কোন সন্দেহ নেই।
অর্থনীতি কিন্তু চলে মানুষের ক্রয় বিক্রয়ের উপর। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি অভ্যান্তরিণ অর্থনীতি। আমদানি রপ্তানি তো আমাদের আছেই। সেখানেও একটা চাপ চলছে। ডলারের দাম অনেক বেড়েছে। সব মিলিয়ে মানুষের দুদর্শা বাড়বে। এটাতে কোন সন্দেহ নেই।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ভর্তুকির বিপক্ষে। কিন্তু ভর্তুকি তুলে দিতে গেলে তার একটা সময় দেয়া প্রয়োজন। আমাদের এখনও ভর্তুকি তুলে দেয়ার মত অর্থনীতি হয়নি। বেশিরভাগ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এখনও সেই পর্যায়ে যায়নি। আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় যদি করতে হয় তবে বিদ্যুতের বা জ্বালানির মূল্য যখন কম থাকবে তখন করা উচিৎ। এতে সাধারণ মানুষের সরকারের প্রতি আস্থা তৈরি হয়। বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়।
জ্বালানির দাম যে উঠা নামা করবে অর্থনীতিও কিন্তু এর সাথে উঠা নামা করবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভর্তুকির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। যদি সেই ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসতে হয়, যে আর ভর্তুকি দেব না তাহলে কিন্তু আমাদের অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। হঠাৎ করে করা যাবে না। হঠাৎ করে শক দিলে হবে না। এখন একটা শকিং সিচ্যুয়েশন। এখন তেলের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি একেবারে বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে।
আসলে সবকিছু স্বচ্ছ হতে হবে। ভাড়া থেকে শুরু করে Ñ ক্রয় মূল্য কিভাবে নির্ধারণ হয়, এখানে কত কর দিতে হয়, ভ্যাট ট্যাক্স কত, পরিবহন খরচ কত সব কিছু যদি স্বচ্ছতার সাথে হয় তবে মূল্যবৃদ্ধি বা কমানোটা মানুষ সহজে মেনে নেয়।
ভবিষ্যতে দাম কমলে দেশের বাজারেও কমবে বলা হচ্ছে। কিন্তু তার নজির কিন্তু ইতিপূর্বে দেখিনি। এর কোন নিশ্চয়তা নেই। কমার সম্ভাবনা কম। একবার বাংলাদেশে কোন কিছুর মূল্য বেড়ে গেলে তা কমার সম্ভাবনা কম।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর উপরভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ। আমি মনে করি সরকার সুচিন্তার সাথে এই বিষয় বিবেচনা করবেন। যদি মূল্যবৃদ্ধি করতেই হয় তবে তা যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হবে।
বিশ্ববাজারে দাম বাড়া-কমার সাথে স্থানীয় বাজারে দাম সমন্বয়ের মতো অবস্থায় বাংলাদেশ এখনও পৌঁছেনি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য মূল্য কাঠামোর এমন একটি নীতিমালা করা উচিৎ যাতে আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামার সময়ও দেশের বাজারের জ্বালানির দাম অপরিবর্তিত থাকে।
২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় তেলের মূল্য বিশ্ববাজারে ১৪৮ ডলারে উঠেছিল। তবে সেই সময়ের পরিস্থিতি আর আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। সেই সময় আমরা মূলত ভর্তুকি দিতাম তেলে। গ্যাস বা বিদ্যুতে ভর্তুকি ছিল না বললেই চলে। এখন সেটা বদলে গেছে।
জ্বালানিতে ভর্তুকি দিয়েই এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক অবকাঠামোটা বাংলাদেশে চলছে। সেখান থেকে বের হতে চাইলে ধীরে ধীরে করতে হবে। এত দ্রুততার সাথে করলে সমস্যা হবে।
আমরা যদি মূল্যটাকে স্থিতিশীল অবস্থায় রাখতে চাই, একটা মূল্য ঠিক করে এবং পুরো অর্থনীতিকে যদি স্থিতি অবস্থায় রাখতে চাই, তাহলে এই জ্বালানির ওঠানামার সময় সরকারের দাম কমানো বাড়ানোর কথাটা আর আসবে না।
যখন দাম কমবে সরকার তখন মুনাফা করবে, গত পাঁচ/সাত বছরে যেটা করেছে। সেই টাকা যদি রেখে দেয়া হয়, আর সামনের উচ্চমূল্যের সময় এই টাকাটা দিয়ে মূল্য স্থিতিশীল রাখা হবে। তাহলে কিন্তু আজকে আমাদের সমস্যাটা হত না।
তেলের দামটা সাইক্লিক। যখন উচ্চমূল্য হয় তখন চাহিদা কমে যায়। মুনাফার জন্য সরবরাহ বেড়ে যায়। তখনই আবার বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ চলে আসে। তার প্রেক্ষিতে দামও কমতে থাকে। কমে গিয়ে আবার একটা স্থবিরতায় এসে অনেকদিন কম মূল্যে চলতে থাকে।
আমার মনে হয়, ভালো নীতিমালার মাধ্যমে যদি আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করি, অর্থনীতির যে কাঠামো, সেখানে তেলের দাম ওঠানামা করবে, তার প্রেক্ষিতে অন্যান্য মূল্য কীভাবে হবে, সেটা আমাদের স্থির করতে হবে। এখনকার পরিস্থিতিতে একটি স্থিতি অবস্থায় জ্বালানি রাখার যে নীতি, সেটা রাখাই ভালো। এখন যে দামটা বাড়ানো হয়েছে তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। দাম আর একটু কমলে বা ভবিষ্যতে মুনাফা হলে, সেই টাকা দিয়ে ভবিষ্যতের উচ্চমূল্য সমন্বয় করতে হবে।
এটা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ আমাদের মতো দেশে। যেখানে পরিবহনখাতে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। সেখানে জ্বালানি মূল্য ওঠানামা করলে সেটা কীভাবে প্রভাবিত করবে দেখতে হবে।
(৭ই আগষ্ট এনার্জি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকার থেকে অনুলিখন)